ছিনতাইয়ে বাধা, কুপিয়ে খুন রেলকর্মী

কাজে যাওয়ার জন্য ভোরের ট্রেন ধরতে বেরিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে হেঁটে কিছুটা এগোতেই পথ আটকাল ছিনতাইবাজরা। মোবাইল ও টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ভোজালির কোপ পড়ল গলায়, পেটে। ছটছট করতে করতে ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারালেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কোন্নগর শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৬ ০২:৩৮
Share:

আদর্শনগরের সেই জায়গা, যেখানে খুন হয় (উপরে)। নীচে, নিহত জয়প্রকাশ গুপ্ত। ডানদিকে, জয়প্রকাশবাবু ষেখানে থাকতেন। ছবি: প্রকাশ পাল

কাজে যাওয়ার জন্য ভোরের ট্রেন ধরতে বেরিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে হেঁটে কিছুটা এগোতেই পথ আটকাল ছিনতাইবাজরা। মোবাইল ও টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ভোজালির কোপ পড়ল গলায়, পেটে। ছটছট করতে করতে ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারালেন।

Advertisement

আধ ঘণ্টার মধ্যে কিছুটা দূরে ফের ছিনতাইবাজদের দৌরাত্ম্য। মাথায় ভোজালির কোপে গুরুতর জখম হলেন আর এক জন।

এই ঘটনার কিছু পরে আবার সেই হামলা। এ বার ছিনতাইবাজদের কবলে পড়লেন এক মাছ ব্যবসায়ী।

Advertisement

এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী টহল দেওয়া শুরু করেছে। তল্লাশি চালিয়ে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের তৎপরতার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ভোটের মুখে এই আবহেও কোন্নগর যেন দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে! আগে দুষ্কর্ম চলছিল রাতের অন্ধকারে। দুষ্কৃতীরা এখন বেপরোয়া ভাবে ভোরের আলোতেই দৌরাত্ম্য শুরু করেছে। একই দিনে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খুন-জখম করতে তারা পিছপা হচ্ছে না। দুষ্কৃতীদের এই তাণ্ডবে স্বাভাবিক ভাবেই আতঙ্কিত কোন্নগরের সাধারণ মানুষ। প্রশ্নের মুখে তাঁদের নিরাপত্তা।

এ দিন খুনের ঘটনাটি যেখানে ঘটে, সেই আদর্শনগর এলাকাটি স্টেশন লাগোয়া। নিহত জয়প্রকাশ গুপ্ত (৫৭) ওই এলাকারই বাসিন্দা। হাওড়া স্টেশনে টিকিট বুকিং কাউন্টারে কাজ করতেন। অন্য ঘটনাগুলি ঘটে ক্রাইপার রোডে এবং বাটার মোড়ে। পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী জানান, এ দিন ভোরে আদর্শনগরে পুলিশ টহল দিয়েছিল। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই খুনের ঘটনাটি ঘটে। দুষ্কৃতীদের ধরতে জোর তল্লাশি চলছে। তবে, পুলিশের একটি অংশ মনে করছে, দুষ্কৃতীরা পুলিশের গতিবিধির উপরে নজর রেখেছিল। কেউ কেউ অবশ্য মেনে নিয়েছেন, ভোরের মুখে নজরদারি কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। সেই সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছে দুষ্কৃতীরা।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আদর্শনগরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন জয়প্রকাশবাবু। তাঁর ছেলেমেয়ে ভিন্ রাজ্যে থাকেন। এ দিন ভোর ৫টা থেকে তাঁর ‘ডিউটি’ ছিল। ট্রেন ধরবেন বলে ৪টে নাগাদ বাড়ি থেকে হেঁটে স্টেশনে যাচ্ছিলেন। তখনই আক্রান্ত হন। রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি পড়ে গেলে দুষ্কৃতীরা পালায়। পরে উত্তরপাড়া থানার পুলিশ গিয়ে দেহটি উদ্ধার করে ময়না-তদন্তের জন্য শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে পাঠায়। নিহতের পরিবারের তরফে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তার ভিত্তিতে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে। জয়প্রকাশবাবুর ব্যাগটি পরে পুলিশ ওই এলাকা থেকেই উদ্ধার করে। যদিও তাতে অফিসের পরিচপত্র ও কাগজপত্র ছাড়া কিছু ছিল না।

এই ঘটনার আধ ঘণ্টার মধ্যে স্টেশন এলাকারই ক্রাইপার রোডে বাবু দাস নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দুষ্কৃতীরা তাঁর মাথায় ভোজালি দিয়ে আঘাত করে। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবু বলেন, ‘‘চলচিত্রম মোড়ের কাছে এক দুষ্কৃতী আমার থেকে টাকাপয়সা চায়। দু’টো ছেলে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা হিন্দিতে কথা বলছিল। ভয় পেয়ে টাকা যা ছিল, দিয়ে দিই। তা সত্ত্বেও আমার মাথায় ভোজালির আঘাত করে।’’ বাবুর পরে এই ক্রাইপার রোডে আরও এক জন ছিনতাইবাজের কবলে পড়েন। তাঁকেও মারধর করা হয়। এর পরে বাটার মোড়ে এক মাছ ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও টাকাপয়সা ছিনতাই করে দুষ্কৃতীরা।

ভোরের ট্রেন ধরতে বহু মানুষকেই স্টেশনে যেতে হয়। কিন্তু রাস্তাঘাটে লোক কম থাকার সুযোগ নিয়ে কোন্নগরে দুষ্কৃতীরা যে ভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে, তাতে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এলাকার মানুষের প্রশ্ন, ভোটকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা আঁটোসাটো করার কথা বলছেন প্রশাসনিক আধিকারিকরা। তার পরেও কী ভাবে সাহস পাচ্ছে দুষ্কৃতীরা? সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার কথা তুলে এ দিনের হামলাকে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মানতে চাইছেন না তাঁরা।

বস্তুত, কোন্নগর স্টেশনের দুই পাড়ে দুষ্কৃতীদের কাজকর্ম বার বারই সামনে আসছে। সম্প্রতি নবগ্রামে দরজা ভেঙে ঘুমন্ত অবস্থায় এক অটোচালককে গুলি করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। সেই ঘটনার এখনও কিনারা হয়নি। কিছু দিন আগেই ভোরে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইকারীদের মারধরে জখম হন এক ব্যক্তি। তার পরেও একই সময়ে এবং কার্যত একই জায়গায় দুষ্কৃতীদের ফের হামলায় সাধারণ মানুষ মনে করছেন, পুলিশ উপযুক্ত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত আদৌ করতে পারেনি।

এই পরিস্থিতিতে এলাকার আইন-শৃঙ্খলার অবনতিকে হাতিয়ার করতে চাইছে বিরোধী দলগুলি। জেলা সিপিএম সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি কোন পর্যায়ে গিয়েছে একের পর এক ঘটনাই তার প্রমাণ। এরপর মানুষ কি রাস্তায় বেরনো বন্ধ করে দেবে!’’ উত্তরপাড়ার সিপিএম প্রার্থী শ্রুতিনাথ প্রহরাজের অভিযোগ, ‘‘কোন্নগরে সমাজবিরোধীরা শাসকদলের মদতেই পর পর কুকর্ম করে বেড়াচ্ছে। পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও ফ‌ল হচ্ছে না।’’ জেলা বিজেপি সভাপতি ভাস্কর ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘তৃণমূলের রাজত্বে সমাজবিরোধীরা সুরক্ষিত, সাধারণ মানুষ নন। সে জন্যই দুষ্কৃতীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’

কী বলছে শাসক দল?

জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি, উত্তরপাড়ার পুরপ্রধান দিলীপ যাদবের দাবি, ‘‘বাম জমানার তুলনায় এখনকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হাজার গুণ ভাল। একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে রং চড়িয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করা হচ্ছে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে। পুলিশ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।’’

বিরোধীরা শাসকদলের কথা শুনে বলছেন, কিছু ঘটলেই ওদের এক রা— ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন