এটিএম ভেঙে টাকা লুঠের ঘটনা মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। কিন্তু আস্ত এ়টিএম-ই তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। তেমনটাই হয়েছিল খাতড়ায়। রাতের অন্ধকারে ওই ঘটনার পরে চোখ কপালে উঠেছিল অনেকের। জেলা পুলিশও বেশ ধন্দে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ হাসি হেসেছিল পুলিশই। তবে সেই রহস্য ভেদ মোটেই সহজ ছিল না।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এক গভীর রাতে খাতড়ার আড়কামা এলাকায় একটি ব্যাঙ্কের এটিএম ভেঙে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। মেশিন মাঠে ফেলে লাখ লাখ টাকা তারা লুঠ করে। এর আগে কিন্তু এই ধরনের ঘটনা জেলায় ঘটেনি। তাই ওই ঘটনা পুলিশকে ভাবিয়ে তুলেছিল। দুষ্কৃতীদের পাকড়াও করাটা মস্ত চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। ওই ঘটনার তদন্তে বিশেষ দল গঠন করে জেলা পুলিশ। পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে বেশ কয়েকটি থানার ওসি, সিআই থেকে সাব-ইন্সপেক্টরদের নিয়ে তদন্ত দল তৈরি হয়।
প্রায় চার মাস আদা-জল খেয়ে তদন্তের কাজে লেগেছিলেন পুলিশ কর্মীরা। গোড়াতেই তাঁরা আঁচ করেছিলেন, আর যাই হোক, এ কাজ মোটেই স্থানীয় দুষ্কৃতীদের নয়। বিভিন্ন সূত্র ধরে পুলিশ কর্মীরা জানতে পারেন ভিন্ জেলা তো নয়ই। এ কাজে যুক্ত ভিন্ রাজ্যের দুষ্কৃতীরা। দুষ্কৃতীদের হদিস পেতে যেতে হয়েছিল উত্তরপ্রদেশেও। সেখানে দশ দিন ধরে বিভিন্ন জেলার থানা চষে বেরিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। পুলিশের ডায়েরি থেকে চুরি, ডাকাতির ঘটনায় অভিযুক্তদের নামের তালিকা জোগাড় করে, তাদের বর্তমান অবস্থা খতিয়ে দেখা হয়। হাজার তিনের দাগি আসামীদের উপর ক্রমাগত নজর রেখে শেষে মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে দুষ্টু চক্রের নাগাল পেয়েছিল বাঁকুড়া জেলা পুলিশ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিশেষ অপারেশন চালিয়ে শেষে তারকেশ্বরের একটি ভাড়াবাড়ি থেকে সাতজনকে ওই এটিএম লুঠের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে।
ধৃত রাম নরেশ, হাকিম সিং, পুরান সিং, রাম সিং, তিলক সিং, মহেন্দ্র সিং, গোকুল সকলেই উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁ জেলার কাদেরচক থানার অন্তর্গত বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তাদের কাছ থেকে নগদ প্রায় ২ লক্ষ ৫ হাজার টাকা, সোনা ও রূপোর গয়না, রূপোর মুদ্রা-সহ শাবল, গাড়ির যন্ত্রপাতি খোলার জ্যাক, বাড়ির দরজা ভাঙার যন্ত্রপাতি প্রভৃতি উদ্ধার হয়েছিল।
কী ভাবে তাদের নাগাল পেয়েছিল পুলিশ? এক পুলিশ আধিকারিক জানাচ্ছেন, বাঁকুড়ায় ইতিপূর্বে ধরা পড়া উত্তরপ্রদেশের একটি ডাকাতদল খাতড়ার লুঠে জড়িত বলে পুলিশের সন্দেহ হয়। কিন্তু ওই দলটি ততদিনে জামিন পেয়ে জেলের বাইরে ছিল। তাদের হদিস পেতেই পুলিশের দল উত্তরপ্রদেশে গিয়েছিল। সেখান থেকে সন্দেহভাজনদের ফোনের ‘কল ডিটেলস রেকর্ড’ সংগ্রহ করে। তার মধ্যে একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোনের হ্যান্ডসেটের আইএমইআই নম্বর বের করে তা ট্র্যাক করে পুলিশ জানতে পারে, ফোনের মালিক তারকেশ্বরে।
এরপরে সাদা পোশাকে পুলিশ বেশ কিছু দিন ধরে নজর রেখেছিল তাদের গতিবিধির উপর। ধৃতেরা সকলেই একটি বাড়িতে থাকত। দিনভর লেপ-কম্বল ফেরি করতে বেরিয়ে এলাকায় তারা রেইকি করত। তারপরে রাতে অস্ত্র নিয়ে চুরি-ডাকাতির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত। খুঁটিয়ে সব খবরাখবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরেই এক দিন কাকভোরে দুষ্কৃতীদের বাড়ি চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে বিশাল পুলিশ বাহিনী।
দুষ্কৃতীরা পুলিশ এসেছে বুঝতে পেরে প্রথমে দরজা না খুলে বাড়ির ছাদে উঠে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে তারা। শেষে পুলিশ দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পাকড়াও করে তাদের। এরই মাঝে অন্যতম অভিযুক্ত গোকুল পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে জখম হয়। এই ভাবে সাতজনকেই হাতেনাতে ধরে ফেলে পুলিশ।
শুধু খাতড়ায় নয়, গত বছর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকাতেই এটিএম লুঠের ঘটনা ঘটেছে। জেলা পুলিশের একটি বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দলটির বেশির ভাগ সদস্যই বাঁকুড়ার ঘটনায় জামিন পেয়ে গেলেও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। ফলে কখনও দুর্গাপুর, কখনও ব্যারাকপুর, কখনও বা হুগলি জেলার বিভিন্ন জেলে ঘুরে ফিরে বেরাতে হচ্ছে তাদের। বাঁকুড়ার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “খাতড়ার এটিএম লুঠে ঘটনাটিকে আমরা বড়সড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলাম। জেলা পুলিশের দক্ষ আধিকারিকদের নিয়ে বিশেষ দল গড়ে তদন্ত করা হয়েছিল। টিমওয়ার্কের জেরেই ওই সাফল্য এসেছিল।