বিকিকিনি। —নিজস্ব চিত্র।
দূর থেকে দেখলে সবুজ হলুদ সরষের ক্ষেতের ভিতর জলরং এ আঁকা ছবির মতো।
ফি বছর পয়লা মাঘের নরম রোদ মেখে সিউড়ির নগরীতে একবেলার জন্য এ ছবি তৈরি হয় ব্রহ্মদৈত্যির মেলাকে ঘিরে। প্রাচীন বট গাছের নীচে ব্রহ্মচারীর আস্তানা ঘিরে মিঠে রোদ মেখে চলে বিকিকিনি। মেলার বয়স কত? জানতে চাইলে, বোষ্টমী উত্তর দেন, ‘‘হিসাব নেই। এক সময় ইন্দ্রনারায়ণ রায় ছিলেন নগরীর জমিদার। তখন এই এলাকা ছিল ঘন বনে ঢাকা। তারাপীঠ থেকে ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়ে বক্রেশ্বর এর পথে পা বাড়াতেন সাধু সন্ন্যাসীর দল। এই বট গাছের তলায় বসত অস্থায়ী অস্থানা, চলত ব্রহ্মচারীর সাধন ভজন, এটি যে হিন্দুদের এক পবিত্র স্থান তার উল্লেখ রয়েছে গেজেটিয়ারের পাতায়। একদিন মেলার প্রচলন হল।’’
কত স্মৃতি মেলা ঘিরে। তাঁতিপাড়ার মোতিলালের কালো কলাইয়ের জিলিপি। পদ্মপুরের বিশাল মাপের বেগুনি। রানীশ্বরের গুটকা বালুসাহী। আর ছিল নারকেল কূল, সরবতি আলু— আরও কত কী! একসময় আদিবাসীরা মেলায় পেতেন তাঁদের পছন্দের সুকুই মাছ। আসনবুনির কুমোররা আসতো গোরুর গাড়ি বোঝাই মাটির হাড়ি, কলসী নিয়ে। থাকত ভান্ডীর বনের বাঁশের ঝুড়ি, কুলো। কড়িধ্যা থেকে পিতল-কাঁসার বাসন। বলছিলেন প্রবীণ তরুণ রায়।
‘‘তখন মেলার দায়িত্বে ছিলেন নগরীর রায় আর তাঁতিপাড়ার পুজারী চক্রবর্তীরা। এখন অবশ্য এই মেলা নিয়ন্ত্রন করে সর্বদলীয় কমিটি’’, বলছিলেন গৌতম রায়। স্মৃতি থেকে কবিতা রায় বলছিলেন, ‘‘এক সময় আদিবাসীরা তাদের পৌষ সংক্রান্তির বান্না পরব শেষে পয়লা মাঘের বিকেলে দল বেধে নাচ গান করে মেলা জমাত। কাঁধের লাঠিতে ঝোলানো থাকত শিকার। সে সব দিন গেছে তবে, আছে মেলার আনন্দটা।’’
এখন কম বেশি পাঁচশো দোকান বসে। মোগলাই থেকে চপ-মুড়ি, সেদ্ধ ডিম, কাচের চুড়ি থেকে কাঠের বাসন, বেতের বোনা ধামা-কুলো থেকে উচ্ছে-বেগুন। এসব কিনতেই সিউড়ি, বড়গ্রাম, পাতরা, নবগ্রাম থেকে কয়েক হাজার মানুষ ভিড়ে জমায়। কীর্তন আর বাউলের সুরে মিলে মিশে একাকার হয় রোদ পড়ে এলে বটের পাতায় গরম প্রসাদী পায়েস হাতে বাড়ি ফেরে ভক্তের দল। শুরু হয় পরের বছরের অপেক্ষা।