১৮ মে, ২০১৪। ব্যাঙ্ক বন্ধের খবরে সিউড়িতে মূল শাখায় ভিড় করেছেন গ্রাহকেরা। —ফাইল চিত্র।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে প্রায় দেড় বছর পর পুনরায় খুলল জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। বৃহস্পতিবার দুপুরে সিউড়িতে সমবায় ব্যাঙ্কের মূল শাখায় পুনরায় কাজকর্মের সূচনা করলেন সমবায় মন্ত্রী জ্যোতির্ময় কর। ছিলেন শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলাসভাধিপতি বিকাশ রায় চৌধুরী, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী, ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, সমবায় আধিকারিক মিস্টার করিম, সিইও আজয় গিরি প্রমুখ। যদিও ব্যাঙ্ক খুলল মানেই সব ঠিকঠাক হয়ে গেল এমনটা কিন্তু নয়। মাথা ব্যাথ্যার সবচেয়ে বড় কারণ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এখনও সমবায় ব্যাঙ্ককে ছাড়পত্র দেয়নি। সেটা নিতে গেলে কয়েকটি শর্তপূরণ করতে হবে ব্যাঙ্ককে জানালেন সমবায় মন্ত্রী স্বয়ং।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া শর্তগুলি, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ব্যাঙ্কে কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেম চালু করা, ঋণ আদায়ে জোর দিয়ে ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনা। ফলে অ্যাকাউন্ট খোলা, টাকা জমা করা সম্ভব হলেও, টাকা তোলা ঋণ নেওয়া এখনই সম্ভব নয়। সোজা কথায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত ব্যাঙ্কের সম্পূ্র্ণ কাজ কর্ম শুরু করা সম্ভব নয় বলছেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। এর ফলে প্রশ্ন একটাই, আমানতকারীরা যদি তাঁদের আমানত তুলতেই না পারেন, তাহলে ব্যাঙ্ক খুলে লাভ কী!
মন্ত্রী জানান, একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই আমানতকারীদের টাকা সুরক্ষিতই রয়েছে। তবে দুটি শর্ত আপাতত পূরণ করতে হবে। এক, কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেম চালু করা। দুই ব্যাঙ্কের যত পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেগুলির আপডেট করা। কেন না যতদিন ধরে ব্যাঙ্কটি বন্ধ রয়েছে তার মধ্যে বহুবার সুদের হার কমা বাড়া করেছে। তাই এই মুহূর্তে টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। শর্ত মিটলে ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য দেখে ধাপে ধাপে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেব। এখানে কোনও ভুল নেই।
কবে থেকে শর্ত পূরনের চেষ্টা করবে ব্যাঙ্ক? মন্ত্রীর বলছেন, ‘‘বৃহস্পতিবার থেকেই কাজ শুরু হচ্ছে। তবে এটা অনির্দিষ্টকাল নিশ্চই নয়। কেন না কলকাতা হাইকোর্ট পুরো বিষয়টির উপর নজর রাখছে। সামনের মাসের আট তারিখ আদালতকে জানাতে হবে কতটা এগোলাম শর্ত পূরণের কাজে। কিন্তু কত সময় লাগবে সেটা বলতে পারব না।’’
প্রসঙ্গত বিপুল খেলাপি ঋণ অনাদায়ী থাকায় গত বছর মে মাসের ১৫ তারিখ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল করার পর থেকেই জেলার ১৭টি শাখা বন্ধ রয়েছে। তারপর কবে খুলবে ব্যাঙ্ক সেই প্রশ্ন নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ব্যাঙ্ক কর্মী, গ্রাহক, সমবায় ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরশীল সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিগুলি, সেগুলির কর্মী, আমানতকারী, অসংখ্য চাষি, স্বল্প সঞ্চয় এজেন্ট সকলেই। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল করার পর থেকেই ব্যাঙ্ক খোলার দাবিতে বহু আন্দোলনও হয়েছে।
জেলা জুড়ে সমবায় ব্যাঙ্কের সবকটি শাখা বন্ধ হওয়ায় সমস্যায় পড়ে যান ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৭৪ জন আমানতকারী। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ৩৫০ কোটি ১২ লক্ষ ৫২ হাজার টাকার ভবিষ্যত কী হবে এটা নিয়ে আজানা আশঙ্কায় ভুগতে শুরু করেন গ্রাহকেরা। কিন্তু মাসের পর মাস ব্যাঙ্ক খোলার কোনও আশা ভরসা না পেয়ে শুধু ব্যাঙ্কের গ্রাহকেরাই নন, অথৈ জলে পড়ে যান সমবায় ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরশীল জেলার ৩৩১টি সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি।
বন্ধ হয়ে যায় চাষিদের কৃষি ঋণ পাওয়া। সবচেয়ে সমস্যায় পড়ে ১০০টির মতো সমবায় সমিতি যে গুলিতে ব্যাঙ্কিং সিস্টেম চালু ছিল। যেহেতু সমবায় সমিতিতে গচ্ছিত আমানতের একটা বড় অংশই সমবায় ব্যাঙ্কে রাখার নির্দেশ ছিল। তাই সমিতিগুলিও তাঁদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়ে বন্ধের মুখে। আসলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম হল, কোনও ঋণ তথা অনুৎপাদক সম্পদের(এনপিএ) পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হওয়া চলবে না। কিন্তু বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছিল, তার ৫২ শতাংশ খেলাপি বা অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হয়। পথ ছিল একটাই রাজ্য সরকার ব্যাঙ্ক বাঁচাতে তখন যদি সেই পরিমাণ টাকা দিয়ে দিত। কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় চরম পদক্ষেপ নেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এরপর ব্যাঙ্ক বাঁচাতে কেন্দ্র রাজ্য এবং নার্বার্ডের তরফে মিলিত ভাবে ৮৮ কোটি টাকা দেওয়া হলেও বেশ কিছু শর্ত চাপায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
কিন্তু ব্যাঙ্ক না খোলা থাকলে যে এগুলো করা সম্ভব নয় বুঝেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আপত্তি শর্তেও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি গত ১৫ জুলাই বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ মেনে ব্যাঙ্ক খুললেও প্রধান প্রশ্ন থেকে গেল যে খেলাফি ঋণ আদায় এত বছরেও সম্ভব হয়নি, সেটা আদায়ে কী পদক্ষেপ নেবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।
মন্ত্রী এ দিন তাও স্পষ্ট করছেন, ‘‘আইনি গণ্ডী বাজায় রেখে ঋণ আদায়ে সচেষ্ট হবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।’’
এই কথাটিই বোর্ড মিটিংয়ে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন মন্ত্রী, বলে জানা গিয়েছে। সেখানে তাঁর পরামর্শ, ‘‘প্রচেষ্টা চালাতে হবে ঋণ আদায়ে, শর্তপূরণ করতে যে যে সূচকগুলি উন্নত করা প্রয়োজন তার একটিও ফেল করলে ব্যাঙ্ক বাঁচনো যাবে না। রাতদিন এক করে চেষ্টা করুন। না হলে কেঁদে ভাসালেও রক্ষা নেই।’’
বৃহস্পতিবার ছবিগুলি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।