লক্ষ্য সম্প্রীতি, পিছিয়ে গেল লাঠির মেলা

জনশ্রুতির সত্যতা কতখানি তা অবশ্য যাচাই করার উপায় নেই। তবে একাদশীর দিনই শতাব্দী প্রাচীন মেলা হয়ে আসছে। মেলাকে ঘিরে ফি বছর সরগরম হয়ে ওঠে দুবরাজপুরের কৃষ্ণনগর এলাকা।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০৪
Share:

হরেক: লাঠির মেলায় চলছে বিকিকিনি। ছবি: নিজস্ব চিত্র

একাদশী নয়, মহরমের জন্য এ বার দ্বাদশীতে সরে এল দুবরাজপুরের যশপুর পঞ্চায়েত এলাকার কৃষ্ণনগরের আয়োজিত শতাব্দী প্রাচীন লাঠির মেলা। সম্প্রীতি বজায় রাখতেই এই সিদ্ধান্ত— জানিয়েছেন মেলার আয়োজক যশপুর পঞ্চায়েত।

Advertisement

শতাব্দী প্রাচীন মেলাকে ঘিরে দু’ধরনের জনশ্রুতি রয়েছে। এক ইংরেজদের শাসনকালে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একমাত্র হাতিয়ার ছিল লাঠি। দুই বর্গি হামলা রুখতে প্রযোজন ছিল লাঠির। প্রচুর লাঠির জোগান দিতে কোনও এক সময় বসেছিল ‘লাঠির মেলা।’

জনশ্রুতির সত্যতা কতখানি তা অবশ্য যাচাই করার উপায় নেই। তবে একাদশীর দিনই শতাব্দী প্রাচীন মেলা হয়ে আসছে। মেলাকে ঘিরে ফি বছর সরগরম হয়ে ওঠে দুবরাজপুরের কৃষ্ণনগর এলাকা। এলাকার সমস্ত দুর্গা প্রতিমাগুলির একসঙ্গে বিসর্জন দেখতে একাদশীর দিন উপস্থিত লোকজনের কাছে লাঠি বিক্রি করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। তারপর থেকে এটি লাঠির মেলা বলেও খ্যাত।

Advertisement

মেলায় হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি সমান। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখেই সহমতের ভিত্তিতে মেলা একদিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বলছেন, যশপুর পঞ্চায়েতের প্রধান কামরুন্নেসা বিবি এবং উপপ্রধান পরিমল সৌ-রা। পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুজোর আগেই দাফায় দফায় পারবারিক দুর্গাপুজো ও কমিটি গুলিকে ও মহরম কমিটি নিয়ে বৈঠকের পরই সকলে দ্বাদশীর দিন লাঠি মেলা সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করেন।

তাতে অবশ্য অফশোস হয়নি। বরং একদিন বাড়তি আনন্দ করার সুজোগ হিসাবেই দেখছেন এলাকার বাসিন্দা মাধব মণ্ডল, সুকুমার বাগাদি, বধূ মনসা ধীবর, বন্দনা সূত্রধরেরা। বলছেন, ‘‘ক্ষতি কী, আনন্দের জন্য একদিন বাড়তি পাওনা হল।’’

জানা গিয়েছে, মেলায় লোক সমাগম ও এলাকার বাসিন্দাদের ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখে বেশ কয়েক বছর আগেই ওই মেলার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয় স্থানীয় যশপুর পঞ্চায়েত। মেলা বসার উপলক্ষ, যশপুর পঞ্চায়েত সূত্রে জানা যাচ্ছে, কৃষ্ণনগর গ্রামে যেখানে এই মেলা বসে, সেখানে আশপাশের চার-পাঁচটি গ্রামের সমস্ত দুর্গা প্রতিমাকে নিয়ে আসা হয়। এবং শোভাযাত্রা-সহ ঘোরানো হয়। স্থানীয় যশপুর, পছিয়াড়া, লোহগ্রাম, কান্তরী, ঘোড়াতড়ি গ্রামের ৯টি প্রতিমা দেখতে মেলায় ভিড় উপচে পড়ে। মেলা শেষে প্রতিটি প্রতিমাকে সংশ্লিষ্ট গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিরঞ্জন করা হয়। মেলায় ঠাকুর দেখা, নাগরদোলায় চাপা, পাপড়, বেলুনের আকর্ষণ তো থাকেই। বাড়তি, লাঠি কেনার সুযোগ।

বছরের পর বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজিরও রেখে চলেছে এই মেলা। এ বারও সেটা বজায় থাকল। যশপুর পঞ্চায়েতের তরেফে জানানো হয়েছে, “এ বারও মেলায় শতাধীক স্টল, খাবারের দোকান, নাগারদোলা সবই ছিল। স্টলগুলিকে বসতে দিয়ে যে আয় হয়, তার পুরোটাই মেলার পিছনে খরচ করা হয়। পঞ্চায়েতের তরফেও কিছু টাকা এই গ্রাম্য ঐতিহ্যশালী মেলা খরচ করার ব্যবস্থাও রয়েছে।”

সোমবার বিকেলে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেল, কমপক্ষে ২০ জন লাঠি বিক্রেতা তাঁদের লাঠির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। বেচাকেনা চলছে লাঠির। এ বার মহরম পেরিয়েছে, তবে পরের বছরের মহরমের জন্যও পছন্দ করে লাঠি কেনেন অনেকে। কেউ কেনেন সাহস একটু বাড়িয়ে নিতে কেউ বা বার্ধক্যের হাতিয়ার হিসাবে। অনেকে আবার স্রেফ শখে বাড়িতে রাখার জন্য দরদাম করে লাঠি কিনছেন।

মাঠের মাঝখানের অংশটি বাদ দিয়ে চারদিকে চওড়া রাস্তা রাখা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে আসা প্রতিমাগুলিতে ওই রাস্তা দিয়েই ঘোরানো হচ্ছে। স্টলগুলিতে এবং রাস্তায় থিকথিক করছে ভিড়। যে দিকে দু’চোখ যায়, শুধুই মানুষের মাথা। শেখ মহিত ও শেখ জফিরুল নামে দুই লাঠি বিক্রেতা বললেন, “যতজন লাঠি বিক্রেতা এখানে এসেছেন, তাঁরা সকলেই পাশের ঝড়িয়া মহম্মদপুরের বাসিন্দা। মাস দুই আগেই বাঁশ থেকে লাঠি তৈরির কাজ শুরু করি আমরা।” গড়ে ১০-১২ টাকা দামের শক্তপোক্ত ওই লাঠিগুলির চাহিদা যে যথেষ্টই।

তবে যেটা মহরেমর সঙ্গে একদিনে লাঠিমেলা ও বিসর্জন একদিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন মেলা দেখতে আসা লাল খান ও শেখ জালালরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘বছরভর কাজ। আনন্দ করার সুযোগ খুব একটা তো হয় না। দুটো একসঙ্গে হলে সেটা করা যেত না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন