কয়লা হবে, পাথর কি থাকবে

শিল্পকে স্বাগত জানালেও, কয়লাখনি গড়ার আগে এলাকাবাসীর স্বার্থ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত থাকা নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। প্রস্তাবিত  ডেউচা-পাঁচামি খনি নিয়ে এলাকায় ঘুরে মিলেছে সেই প্রতিক্রিয়াই।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৫৪
Share:

শ্রমজীবী: পাথর খাদানে কাজে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। মহম্মদবাজারের পাঁচামিতে। নিজস্ব চিত্র

রাজ্য সরকার একক ভাবে ডেউচা-পাঁচামি খনি গড়ে কয়লা উত্তোলন করবে— বুধবার নবান্নে এমনই জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একইসঙ্গে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, এলাকার মানুষের পূর্ণ আস্থা অর্জন করার পরেই মহম্মদবাজারে দেশের বৃহত্তম কয়লা খনি তৈরির কাজে হাত পড়বে।

Advertisement

শিল্পকে স্বাগত জানালেও, কয়লাখনি গড়ার আগে এলাকাবাসীর স্বার্থ ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত থাকা নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। প্রস্তাবিত ডেউচা-পাঁচামি খনি নিয়ে এলাকায় ঘুরে মিলেছে সেই প্রতিক্রিয়াই।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, মহম্মদবাজার এলাকায় ডেউচা–পাঁচামিতে পাথর খাদানের নীচে মজুত রয়েছে উন্নতমানের বিশাল কয়লা ভাণ্ডার। ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষায় তার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল অনেক বছর আগেই। প্রাথমিক ভাবে অনুমান, ২০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা সেখানে মজুত রয়েছে।

Advertisement

কয়লা মন্ত্রক সূত্রে খবর, তা তৈরি হলে দেশের সব থেকে বড় কয়লাখনি হবে সেটিই। ২০১৫ সালে মোট ১৭টি কয়লা ব্লককে কয়লা মন্ত্রকের তরফে বন্টন করা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনিও।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জয়দেব-কেঁদুলিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লাখনি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ওই প্রকল্পে বিনিয়োগ হবে আনুমানিক ২০ হাজার কোটি টাকা। সেই সময় কয়লা মন্ত্রক কয়লা ব্লকে খনি গড়ে তোলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও শতদ্রু জলবিদ্যুৎ নিগমকে যৌথ ভাবে দায়িত্ব দিয়েছিল। অন্য রাজ্যগুলি না আগ্রহ না দেখানোয় একক ভাবে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব পায় বাংলা। বছরখানেক আগেই তা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী সপ্তাহে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের এ সংক্রান্ত মউ স্বাক্ষর হওয়ার কথা। বছর পাঁচেকের মধ্যে ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আগামী ১০০ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ রাজ্যে কয়লার অভাব হবে না। কর্মসংস্থান হবে লক্ষাধিক মানুষের। এমন কথা নবান্নে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

এমন খবরে উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। কিন্তু ভাল লাগার পাশাপাশি অজানা আশঙ্কাও রয়েছে এলাকাবাসীর। তাঁদের কেউ বলেন, ‘‘শিল্প হবে ভাল কথা। কিন্তু শিল্পের জন্য যাঁদের ভিটেমাটি হারাতে হবে, তাঁদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন প্যাকেজ কী হবে তা জানা নেই।’’ কেউ বললেন, ‘‘অবৈধ তকমা পেলেও পাথর শিল্পাঞ্চল এলাকায় জীবন-জীবিকার মেরুদণ্ড। কয়লাখনি গড়তে গিয়ে পাথর শিল্পাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তো?’’ অনেকে আবার আশঙ্কাপ্রকাশ করেন— ‘‘যে এলাকায় কয়লাখনি হবে, সেখানে বসবাসকারী আদিবাসী ও প্রান্তিক পরিবারের অনেকের জমির কাগজপত্রই ঠিক নেই। সরকার তাদের কথা ভাববে তো?’’

জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকেরা এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে সরকারি তথ্য বলছে, কয়লাখনি তৈরি হবে মহম্মদবাজার ব্লকের ভাঁড়কাটা, হিংলো, সেকেড্ডা ও পুরাতনগ্রাম পঞ্চায়েতের ১১ হাজার ২২২ একর জমিতে। প্রস্তাবিত ওই খনি এলাকায় ৪২টি গ্রামে ১৯ হাজার মানুষ বসবাস করেন। তাঁদের মধ্যে ৭ হাজার আদিবাসী সম্প্রদায়ের। প্রস্তাবিত জমির মধ্যে কিছু খাস বা সরকারি জমি ও বন দফতরের জমি রয়েছে। তবুও এত সংখ্যক মানুষকে সরিয়ে খনি গড়ার শর্ত কী হবে, সেটাই এখন তাঁদের সব চেয়ে বড় জিজ্ঞাসা।

ভাঁড়কাটার প্রধান সুপ্রিয়া কোনাই বলছেন, ‘‘খুব ভাল খবর। এলাকার উন্নয়ন হবে।’’ ঠিক তখনই ভাঁড়কাঁটা অঞ্চলের বাসিন্দা সিধু হাঁসদা, বাবুলাল টুডুদের গলায় ভিন্ন সুর। তাঁরা বলছেন, ‘‘শিল্প হচ্ছে ভাল কথা। কিন্তু কী শর্তে জমি নেবে সরকার, সেটা পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে এলাকার প্রান্তিক মানুষ যাঁদের জমির কাগজপত্র ঠিক নেই, তাঁদের কী হবে?’’ হিংলো গ্রাম পঞ্চায়েতের হরিণশিঙা গ্রামের জয়দেব মাহাত, সাধু মাহাত বলছেন, ‘‘এলাকাবাসীকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন প্যাকেজ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে শিল্প গড়লে অসুবিধা নেই।’’ একই বক্তব্য হিংলোর উপপ্রধান শিবদাস দাসের। তাঁর সংযোজন, ‘‘এ সবের মধ্যে মধ্যসত্ত্বভোগীরা না ঢুকে পড়ে, সেটাও যেন দেখে সরকার।’’

সেকেড্ডা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান মহম্মদ রুসাই আলি বা পুরাতনগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান আর্জিনা বিবি বলছেন— ‘‘শিল্পকে স্বাগত। তবে কোন কোন গ্রাম নেওয়া হবে, তা জানতে পারিনি।’’

তবে যে জায়গাটি নিয়ে সকলের সব চেয়ে বেশি চিন্তা, তা হল পাথর শিল্পাঞ্চল। আদিবাসী গাঁওতা নেতা রবীন সরেন-সহ অনেকেই বলছেন, ‘‘অবৈধ ভাবে চললেও পাথর শিল্পাঞ্চলই এই এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা। গোটা ব্লকের প্রচুর মানুষ সেখানে কাজ করেন। যে অঞ্চলে কয়লাখনি গড়ে উঠবে, সেটা মূলত পাথর শিল্পাঞ্চল। পাথর শিল্প রেখে নাকি বন্ধ করে খনি গড়া হবে, সেটা স্পষ্ট নয়। হলেও জমিমালিকেরা ছাড়া এই শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে জড়িতদের কী হবে, তার উত্তর পাওয়া বাকি।’’

প্রশাসনের কর্তারা জানিয়েছেন, এখন এলাকায় সমীক্ষার কাজ শুরু করবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। বাকি সব কিছু তার পরেই হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন