নবাব ফিরবে কার কাছে, ঝুলে রইল সিদ্ধান্ত

শিশুটির যাতে ভাল হয়, দু’পক্ষ বসে যদি এমন কোনও সিদ্ধান্ত বের করতে পারেন, তার অবকাশ দিয়েছেন বিচারক। এমনটাই জানিয়েছেন, সিউড়ি আদালতের সরকারি প্লিডার শ্রীকান্ত রায় এবং দত্তক নিতে আগ্রহী দম্পতির পক্ষে থাকা আইনজীবী কৌশিক মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৮ ০২:৩৫
Share:

টানাপড়েন: ছেলের ছবি হাতে নুরাঙ্গিনী বিবি। নতুন মা (ডান দিকে)। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

দত্তকের আবেদনকারী দম্পতি, না কি জন্মদাত্রী মায়ের কাছে ফেরানো হবে ছোট্ট ‘নবাব’কে? সেই সিদ্ধান্ত সিউড়ি আদালতে ঝুলে থাকল মঙ্গলবারও। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে মে মাসের ৫ তারিখ। তার আগে শিশুটির যাতে ভাল হয়, দু’পক্ষ বসে যদি এমন কোনও সিদ্ধান্ত বের করতে পারেন, তার অবকাশ দিয়েছেন বিচারক। এমনটাই জানিয়েছেন, সিউড়ি আদালতের সরকারি প্লিডার শ্রীকান্ত রায় এবং দত্তক নিতে আগ্রহী দম্পতির পক্ষে থাকা আইনজীবী কৌশিক মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

ঘটনা হল, লোহাপুরের বাসিন্দা দুলাল শেখ ও নুরাঙ্গিনি বিবির বছর চারেকের ছেলে নবাব দু’বছর চার মাস আগে নলহাটি স্টেশন থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। দিনমজুর পরিবার অনেক খুঁজেও তাকে পায়নি। নলহাটি থানায় নিখোঁজ ডায়েরিও হয়। ২০১৬-র ২১ মার্চ সাঁইথিয়ার পুনুর গ্রামে একটি শিশুর হদিস মেলে। নাম বলেছিল নবাব। বাবার নাম দুলাল শেখ। ঠিকানা জানাতে পারেনি। পুলিশ, চাইল্ডলাইন, শিশুকল্যাণ সমিতি (সিডব্লিউসি) ঘুরে তার ঠাঁই হয় সিউড়িতে স্পেশ্যাল অ্যাডাপ্টেশন সেন্টারে। শিশুটির বাবা–মাকে খোঁজার চেষ্টা করা হয়। লাভ হয়নি। কলকাতার তিলজলার এক নিঃসন্তান দম্পতি সেই বছরেই ‘কারা’-র (সেন্ট্রাল অ্যাডাপ্টেশন রিসোর্সেস অথরিটি) পোর্টালে দত্তক নিতে আবেদন জানান। আবেদন মেনে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে থেকে শিশুটি সাময়িক ভাবে ওই দম্পতির কাছেই থাকছিল। তার নাম রাখা হয় আরাফত আলি। মামলার চূড়ান্ত শুনানি ছিল গত ২২ ফেব্রুয়ারি। সে দিনই জজ পার্থসারথি সেনের সামনেই ঘটেছিল বিরল ঘটনাটি।

প্রথা মেনে দত্তকের আবেদন জানানো কলকাতার এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছেই সে দিন বছর ছ’য়কের ছোট্ট ‘নবাব’কে পাকাপাকি ভাবে তুলে দেওয়ার কথা ছিল সে দিন। অপেক্ষা ছিল শুধু কোর্টের রায়ের। ঠিক তখনই জানা গিয়েছিল, শিশুটির প্রকৃত বাবা-মা আছেন। ছেলের অপেক্ষায় দিন গুনছেন তাঁরাও। এর পরেই বদলে যায় পরিবেশ। কার কাছে যাবে শিশুটি, নতুন বাবা-মা, নাকি তার প্রকৃত বাবা-মায়ের কাছে, দত্তক দেওয়ার আইনগত বাধা না থাকলেও সে দিন দ্বিধাবিভক্ত ছিল আদালত। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছিলেন বিচারক। শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল মঙ্গলবার। কিন্তু এ দিনও অমীমাংসিত থেকে গেল বিষয়টি।

Advertisement

কী করে খোঁজ মিলল শিশুটির প্রকৃত মা-বাবার? জানা গিয়েছে, আগের দিন কলকাতার নিঃসন্তান দম্পতি যখন শিশুটিকে নিয়ে যখন আদালতে ঢুকছেন, তখন অন্য একটি মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে হাজির ছিলেন লোহাপুরে শিশুটির আসল বাড়ির ঠিক পাশেই থাকা প্রতিবেশিনী গুলেনুর বিবি। দু’বছর পেরিয়ে গেলেও শিশুটি হাত নেড়ে ওই মহিলাকে কিছু যেন বলছিল। ওই মহিলাই প্রথম জানান, শিশুটি তাঁর এক প্রতিবেশীর হারানো সন্তান। যে হারিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওঁর কাছেই থাকত। খবর পাওয়ার পর থেকেই হারানো ছেলেকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেন প্রকৃত বাবা-মা। সিউড়ি আদালতের সরকারি ‘প্লিডার’ শ্রীকান্ত রায়ের কথায়, ‘‘আইনত দত্তক নিতে বাধা নেই ওই দম্পতির। কিন্তু, আইন আগে না মানবিকতা, সেটাই মূল প্রশ্ন।’’

অত্যন্ত সংবেদনশীল এই মামলায় যাতে আর কেউ অংশ নিতে না পরে, সেই জন্য মঙ্গলবার ক্যামেরা কোর্ট করার সিদ্ধান্ত নেন জেলা জজ। আইনজীবী জয়গোপাল দাসের মাধ্যমে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে সিউড়ি জেলা জজের কাছে মঙ্গলবার আবেদন জানান নুরাঙ্গিনী এবং দুলাল শেখরা। আদালত তাঁদের আবেদন গ্রহণ করেন। অন্য দিকে, শিশুটি ছাড়াই আদালতে এসেছিলেন কলকাতার ওই দম্পতি। কিন্তু, যে শিশুর অধিকারের জন্য লড়াই সেই শিশুটিকেই অসুস্থতার জন্য আনেননি তার নতুন বাবা-মা। নুরাঙ্গিনী বলছেন, ‘‘ছেলেকে ফিরে পাওয়াই লক্ষ্য।’’ যদিও এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেননি কলকাতার দম্পতি।

আইনজীবী কৌশিক মুখোপাধ্যায়, সরকারি প্লিডার শ্রীকান্তবাবুরা বলছেন, ‘‘প্রকৃত বাবা-মা ছেলেকে ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু, ওঁদের আর্থিক সঙ্গতি নেই।’’ অন্য দিকে, প্রায় ১৫ মাস ধরে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করছেন কলকাতার ওই আর্থিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত দম্পতি। স্কুলে ভর্তি করেছেন ছেলেকে। এত দিন থাকার পরে তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অমানবিক। বিচারক এই অবস্থায় দুই বাবা-মাকে জানিয়েছেন, শিশুটির ভালর জন্য পথ খুঁজুন। কিন্তু, নবাবের বাবা-মা ঠিক কী পথ খুঁজছেন, সেটার উপর দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন