তখন প্রশিক্ষণের মধ্যপর্ব। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।
কম্পিউটারের মনিটারে এর আগেও বহুবার নিজেদের নাম দেখেছেন রূপা বাগদি, রেণুকা দলুইরা। কিন্তু এই প্রথম তাঁরা মনিটারে নিজেদের নাম দেখে উচ্ছ্বসিত। কারণ এর আগে তাঁদের নাম লিখেছেন অন্যজন। এই প্রথম তাঁরা নিজের নাম নিজে লিখলেন কম্পিউটারে টাইপ করে!
সেই কবে বর্ণ-পরিচয়ে অ-আ-ক-খ শিখেছিলেন। ভাবেননি পরিণত বয়সে পৌঁচ্ছেও ফের একইভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। না করে উপায়ই বা কি। শনিবার দিনভর তাই শান্ত পড়ুয়ার মতো পাঠ নিলেন লাভপুরের কুরুন্নাহার পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কল্যাণী কোনাই, দাঁড়কার প্রধান রেনুকা দলুই, ঠিবার রূপা বাগদিদের মতো ১৩ জন জন প্রতিনিধি। আর তাঁদের পাঠ দিলেন মাস্টারমশাই খোদ বিডিও। দিনভর তাঁদের শেখানো হল কম্পিউটারে অ-আ-ক-খ।
প্রশাসন সূত্রে খবর, একসময় সংরক্ষণ জনিত কারণে বহু নিরক্ষরকেও ত্রিস্ত্রর পঞ্চায়েতে প্রার্থী করা হয়। ভোটে জিতে তাঁরা প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পর্যন্ত হয়েছেন। পরে বিভিন্ন নথিপত্রে স্বাক্ষরের প্রয়োজনে তাঁরা কোনও দলীয় কিংবা পঞ্চায়েত কর্মীকে ধরে ছবি আঁকার মতো নিজেদের নামের আঁক সইটুকু রপ্ত করেন। তারপর বিভিন্ন নথিতে সেই আঁক সই দিয়েই কাজ চালান। কিন্তু না বুঝে ওইভাবে কাজ চালাতে গিয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে পড়েন জনপ্রতিনিধিরা। লাভপুরেই জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছে কয়েকজন প্রধানকে। বর্তমানে অবশ্য লাভপুরে ‘আঁকসই’-এর পর্যায়ে নেই কোনও জনপ্রতিনিধি। কিন্তু কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁরা সেই পর্যায়েই রয়েছেন।
অথচ পঞ্চায়েত পরিচালনার কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। কিন্তু তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রধান-সহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিরা পুরোপুরি পর মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছেন। কর্মীদের উপরেই নির্ভর করে তাঁদের কাজ চালাতে হচ্ছে। এবার সেই পর নির্ভরশীলতা কাটাতে প্রধান, উপপ্রধান-সহ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করল লাভপুর ব্লক প্রশাসন। শনিবার পঞ্চায়েত সমিতির কম্পিউটার কক্ষে ওই প্রশিক্ষণের সূচনা হয়। টানা তিন মাস ধরে প্রতি শনি এবং রবিবার জনপ্রতিনিধিদের ওই প্রশিক্ষণ
দেওয়া হবে।
এ দিনের প্রশিক্ষণে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কাবেরিকা গুঁই, বনভূমি কর্মাধ্যক্ষ নুরুল হুদা, বিভিন্ন পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধানেরা হাজির ছিলেন। তাঁদের কার্যত হাতে ধরে কম্পিউটারের অ-আ-ক-খ শেখান খোদ বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস। রাখা হয়েছে বেতনভুক একজন প্রশিক্ষকও। প্রথমেই ওইসব জনপ্রতিনিধিদের শেখানো হয় কি করে কম্পিউটার খুলতে এবং বন্ধ করতে হয়। কাকে বলে মনিটর, সিপিইউ, কি-বোর্ড কিংবা মাউস। কম্পিউটারের ওইসব পরিভাষায় প্রথম দিকে জনপ্রতিনিধিদের দৃশ্যত কিছুটা অমনযোগী পড়ুয়াদের মতো লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখে হাসি ফোটে। একের পর এক অক্ষর টিপে মনিটরে নিজেদের নাম ভাসতে দেখেই আত্মপ্রত্যয় দেখা যায় জনপ্রতিনিধিদের চোখেমুখে।
পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কাবেরিকা গুই থেকে শুরু করে জামনা পঞ্চায়েতের প্রধান ছবি পাল, লাভপুর ২ নং পঞ্চায়েতের প্রধান শ্রাবণী দাসরা জানান, দফতরের সব কাজেই আমরা দায়বদ্ধ। কিন্তু কম্পিউটারের জ্ঞান না থাকায় আমাদের না জেনে-বুঝে অন্যের কথাই সই করে দিতে হয়। এতদিন অফিসের কম্পিউটার রুমে কর্মীকেই খুঁটখাট করতে দেখেছি। নিজেদের শেখার কথা মনেও হয়নি। এবার থেকে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তো আসবই, সুযোগমতো পঞ্চায়েতে অভ্যাস করব।
ব্লক প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে, বর্তমানে জন্ম-মৃত্যু-সহ বিভিন্ন শংসাপত্র, তথ্য সংরক্ষণ, বিভিন্ন প্রকল্পের নজরদারি, ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে সরাসরি পাশ বইয়ে মজুর এবং ঠিকাদারদের টাকা স্থানান্তর পুরোপুরি কম্পিউটার নির্ভর। ওইসব বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা রয়েছে প্রধানের। অথচ অধিকাংশ প্রধানই কম্পিউটার করতে জানেন না। তাঁদের সবসময় কর্মীদের উপর নির্ভর করতে হয়। সংশ্লিষ্ট লাভপুর ব্লকের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘এরপর থেকে যাতে আর জনপ্রতিনিধিদের পরের উপর নির্ভর করতে না হয় তার জন্য এ উদ্যোগ।’’