বিষ্ণুপুরে ঝুঁকির পারাপার।—ফাইল চিত্র।
তিনটি হাতির প্রাণের বিনিময়ে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে রেল এবং বন দফতর। শনিবার দুই দফতরের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, বিষ্ণুপুর-পাঞ্চেত বন বিভাগের সঙ্গে রেলের মধ্যে একটি সমন্বয় কমিটি হবে। বৈঠকে ঠিক হয়েছে, বিষ্ণপুর-পাঞ্চেত বনবিভাগের সঙ্গে রেলের সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। বিষ্ণপুর বন বিভাগের কর্মীরা নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন বা এসএমএস করে রেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।
পিয়ারডোবা ও বিষ্ণুপুর স্টেশনের মাঝামাঝি দুই লাগোয়া গ্রাম ভালুকা ও ঘুঘুমুড়ার কাছে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ৬টি হাতি রেললাইন পারাপারের সময় আপ খড়্গপুর-আদ্রা পাসেঞ্জারের সামনে এসে পড়ে। দু’টি ছোট হাতি ট্রেনের চাকার তলায় ঢুকে মারা যায়। বাচ্চাকে বাঁচাতে এসে ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মারা যায় মা হতিটিও। তিনটিই মাদি হাতি। ওই ঘটনার পরেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ এবং রেল মন্ত্রকের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হওয়া সত্ত্বেও কেন হাতির করিডর বলে পরিচিত এলাকায় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে না?
শনিবার বিকেলে বিষ্ণুপুর-পাঞ্চেত বন বিভাগের অফিসে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের আদ্রা ডিভিশন এবং বন দফতরের কর্তারা বৈঠকে বসেন। ডিআরএম (আদ্রা) অনশূল গুপ্তর কথায়, ‘‘চক্রধরপুর এবং উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে হাতির যাতায়াত নিয়ে বন দফতরের এক জন কর্মী রেলের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রক্ষা করেন। শনিবার বন দফতরের সঙ্গে রেলের বৈঠকে বিষ্ণুপুরেও সেই ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ ডিএফও (বিষ্ণুপুর পাঞ্চেত বন বিভাগ) অয়ন ঘোষ বলেন, ‘‘এর জন্য নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।’’ সূত্রের খবর, হাতি যাতায়াতের সময় এলাকায় মাচা করে বন দফতরের কর্মীরা নজরদারি চালাবেন। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন মতো তাঁরা নিজেরাই চালককে সঙ্কেত দেবেন বলে বৈঠকে ঠিক হয়েছে। তবে, ডিআরএম আবারও দাবি করেছেন, শুক্রবার রাতের দুর্ঘটনাটি বন দফতরের পক্ষ থেকে হাতি যাতায়াতের আগাম খবর না দেওয়ার ফলেই ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বন দফতরের এক পদস্থ কর্তা বলেছেন, ‘‘হাতি থাকলে রেল কর্তৃপক্ষকে আগাম খবর জানিয়ে আমরা অনুরোধ করব, যাতে ওই করডিরে ট্রেনের গতি ২০-২৫ কিমির মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়।’’
বস্তুত, অতীতেও ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর পরে এই দাবি উঠেছিল রেলের অন্দরেও। ট্রেন চালকদের সংগঠন থেকে শুরু করে রেলের কর্মী সংগঠন, সব পক্ষই বলছে, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রিত করা হলে শুক্রবার রাতের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হত। যদিও আদ্রা ডিভিশনের আদ্রা-মেদিনীপুর শাখার বিষ্ণুপুর এলাকায় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রিত করার কোনও স্থায়ী পরিকল্পনা আপাতত তাঁদের নেই বলেই জানাচ্ছেন রেল কর্তৃপক্ষ। রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, কোনও এলাকায় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একক ভাবে কোনও ডিভিশনের এক্তিয়ারে নেই। ফলে পরবর্তী সময়ে ফের একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মত ওই পথের ট্রেন চালকদের একাংশের।
আদ্রা-মেদিনীপুর শাখা দিয়ে রাজধানী, দুরন্তের মতো উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চলে। এক্সপ্রেস বা মেল ট্রেনগুলির গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। আর সাধারণ প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিবেগে চলে। রেল সূত্রে জানা যাচ্ছে, শুক্রবার যে ট্রেনের ধাক্কায় হাতিগুলির মৃত্যু হয়েছে, সেই খড়গপুর-আদ্রা প্যাসেঞ্জারের গতিবেগ ওই সময়ে ছিল ঘণ্টায় ৮০-৯০ কিলোমিটার। ফলে আপৎকালীন ব্রেক কষলেও দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হত না বলে মত ট্রেনের চালকদের একাংশের। রেল সূত্রের খবর, বিষ্ণুপুরের ওই এলাকায় বর্তমানে সর্তকতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে চালকদের টানা হর্ন বাজিয়ে ও তীক্ষ্ণ নজর রেখে ট্রেন চালানোর জন্য নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু শুধু এই সর্তকতা অবলম্বন করেই ওই ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছেন ট্রেন চালকদের একাংশ। তাঁদের মতে, উপায় একটাই। ওই এলাকায় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রিত করা। ট্রেন চালকদের একটি সংগঠনের বক্তব্য, ট্রেনের ধাক্কায় হাতি মৃত্যু ঠেকাতে আগেই তাদের তরফে বিষ্ণুপুরের ওই এলাকায় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রিত করার দাবি রেল কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল।
অন্য দিকে, দুর্ঘটনাস্থল সংলগ্ন কুলুপুকুর, মড়ার, লাউবাগান, ঢ্যাংগাসোল গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, ভালুকা ও ঘুঘুমুড়ার মাঝামাঝি একটি হল্ট স্টেশন হলে ট্রেনের গতি কমবে। ভালুকা গ্রামের সাইফুদ্দিন মন্ডল, ঘুঘুমুড়ার অমল দাস, মড়ার গ্রামের পরিতোষ ঘোষদের কথায়, ‘‘আমাদের এই এলাকায় হাতিদের আনাগোনা বছরভর চলে। আমরা চাইছি এখানে হল্ট স্টেশন। এতে ট্রেনের গতি কমবে, হাতিদের বেঘোরে মরতে হবে না। স্থানীয় বাসিন্দারাও উপকৃত হবেন।’’