গাছ লাগানো নেশা, স্বীকৃতি বন দফতরের

এই বৃদ্ধের নাম দুখু মাঝি। বয়স, ষাট পেরিয়েছে। বাস, বাঘমুণ্ডি ব্লকের প্রত্যন্ত সিঁদরি গ্রামে। নেশা, বৃক্ষরোপণ করা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঘমুণ্ডি শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৯ ০১:১৪
Share:

যত্নআত্তি: অরণ্য সপ্তাহের শুরুতে দুখু মাঝি। ছবি: সুজিত মাহাতো

কোনও দিন স্কুলের গণ্ডি মাড়াননি। তা নির্দ্বিধায় বলেনও বৃদ্ধ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের স্বামী ভক্তিপ্রভানন্দ যখন জগদীশচন্দ্র বসুর গাছের প্রাণ আবিষ্কারের কথা বলছেন, দর্শকের আসনে বসে খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সেই বৃদ্ধের মুখ। পরে বলেছেন, ‘‘আজ্ঞে, আমি তো অতশত জানি না। তবে গাছ লাগালে যে মানুষের ভাল হয় সে টুকু বুঝতে পারি।’’

Advertisement

এই বৃদ্ধের নাম দুখু মাঝি। বয়স, ষাট পেরিয়েছে। বাস, বাঘমুণ্ডি ব্লকের প্রত্যন্ত সিঁদরি গ্রামে। নেশা, বৃক্ষরোপণ করা। বন দফতরের হাজারো প্রচার সত্ত্বেও যেখানে অরণ্য নিধন বন্ধ হয়নি, সেখানে খাতায়কলমে নিরক্ষর, ‘মুখ্যুসুখ্যু’ দুখু একা একাই বনসৃজনের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। যত্নে বড় করে চলেছেন বট, অশ্বত্থ, পলাশ আরও কত কী গাছ। রবিবার এই দুখু মাঝিকে বনমহোৎসবের মঞ্চে পুরস্কৃত করল বন দফতর। এ দিন তাঁর হাতে গাছের চারা ও মানপত্র তুলে দেন বন দফতরের দক্ষিণ-পশ্চিম চক্রের মুখ্য বনপাল সৌরভ চৌধুরী।

বাঘমুণ্ডির কালিমাটি বিটের আধিকারিক সীতারাম মাহাতোর কথায়, ‘‘চড়িদা-বীরগ্রাম রাস্তা, ডাভা-সিন্দরি রাস্তা, এরকম বেশ কয়েকটি রাস্তা জুড়ে বড় বড় গাছ যে রয়েছে, সেগুলো দুখু লাগিয়েছেন।’’ লজ্জা পেয়ে দুখু বলেন, ‘‘রুক্ষ জমিতে যদি দুটো গাছ থাকে কত ভাল লাগে বলুন তো!’’ কিন্তু হঠাৎ এই গাছ লাগানোর নেশা কেন? দুখুর কথায়, ‘‘তখন বয়স ওই পঁচিশ-তিরিশ হবে। একজন বড় অফিসারের মুখে শুনলাম গাছ নাকি অক্সিজেন না কী একটা দেয়! কিন্তু এই অক্সিজেন কী, কিছুই জানতাম না। কথার ফাঁকে অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে বললেন, এর জন্যই তো আমরা শ্বাস নিতে পারি।’’ বড় অফিসারের সেই কথা যুবক দুখুর মনে ধরেছিল। সবটা না বুঝলেও সেই থেকেই গাছ লাগানোর নেশা চাপে তাঁর মাথায়।

Advertisement

কিন্তু নেশা চাপলে কী হবে! গাছের বেড়া দিতে গিয়ে কী কম হ্যাপা পোহাতে হয় তাঁকে? শুকনো কাঠের বেড়া দিতে না দিতেই লোকজন জ্বালানির জন্য সে সব খুলে নিয়ে পালাত এক সময়। চুরি আটকাতে এক অভিনব বুদ্ধি আসে দুখুর মাথায়। শ্মশান থেকে আধপোড়া কাঠ ও ছেঁড়া নোংরা কাপড় দিয়ে গাছের চারদিকে বেড়াদিতে শুরু করেন তিনি। শ্মশানের আধপোড়া কাঠ আর ছেঁড়া কাপড় তো আর কেউ ছোঁবে না। বৃদ্ধ অবশ্য বলেন, ‘‘গাছ বাঁচলেই হল। আমার বৌ ফুনগি মাঝানও বলে গাছটাকে কোনরকমে বাঁচাবে। তাহলেই হল।’’ এই ভাবে এক একটি গাছকে সন্তানস্নেহে দিনে দিনে বড় করে তোলেন দুখু।

স্ত্রী, দুই ছেলে নিয়ে দুখুর অভাবের সংসার। সামান্য চাষবাস ছাড়া আয় বলতে বয়স্ক ভাতার সামান্য টাকা। বড় ছেলে দিনমজুরি করেন। ছোট ছেলে দীর্ঘদিন অসুস্থ। প্রতি মাসে চিকিৎসার জন্য রাঁচী তাঁকে নিয়ে যেতে হয়। তার ও একটা অর্থ খরচ রয়েছে।

বাঘমুণ্ডির রেঞ্জার মনোজ কুমার মল্লের বলেন, ‘‘নিজের এলাকায় ১৮ কিলোমিটার রাস্তায় গাছ লাগিয়েছেন এই মানুষটি। শুধু রাস্তার ধারেই নয়, মন্দিরে, শ্মশানে যেখানে লাগানোর মনে হয় কোনও না কোনও জায়গা থেকে চারা জোগাড় করে এনে
লাগিয়ে দেন।’’ ডিএফও কংসাবতী (উত্তর) অমৃতা দত্ত বলেন, ‘‘গোটা জীবন ধরে গাছ লাগানোর কাজ করে যাচ্ছেন এমন এক বৃক্ষপ্রেমীকে আজ আমরা সংবর্ধিত করলাম।’’ অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) মুফতি শামিম শওকত দুখুর সঙ্গে মিল খুঁজেছেন আরণ্যকের যুগল প্রসাদের। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্গম জায়গা থেকে এ ভাবেই যুগল প্রসাদ গাছ নিয়ে এসে নদীর ধারে ও অন্যত্র লাগাতেন। যুগল প্রসাদেরা আজও বেঁচে আছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন