Morning Song

চরিত্র হারাচ্ছে ভোরের টহল, প্রবীণেরা স্মৃতিমেদুর

লোক গবেষকেরা জানাচ্ছেন, নবান্নের দিন পর্যন্ত গান গাওয়ার পিছনেও যুক্তি আছে। কারণ জনশ্রুতি, ওই দিন নানা কাজের চাপের পাশাপাশি ধরিত্রী এবং পিতৃপুরুষকে নবান না করিয়ে খাওয়া যায় না।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:১০
Share:

টহল গান। —ফাইল চিত্র।

‘‘জাগো গো শ্যামের কমলিনী রাই/ পুব দিকে চেয়ে দেখ আর নিশি নাই।’’ এক সময়ে ভোরে এ ধরনের টহল বা ভোরাই গান শুনে গ্রামগঞ্জের বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙত। চর্চার অভাবে সেই গান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কোথাও এ গান চরিত্র হারিয়ে নিছকই রোজগারের পথ হয়ে উঠেছে। তাই টহল গান শুনে এখন আর অনেকের মন ভরছে না।

Advertisement

কার্তিকের প্রথম দিন থেকে অগ্রহায়ণের শুরু দিন পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে ভোরে টহল গান শোনা যেত। কোথাও নবান্নের দিন পর্যন্তও শোনা যেত ওই গান। এক মাস কৃষ্ণকীর্তনের একটি পর্ব শুনিয়ে যেতেন গায়কেরা। শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধিকা বা চৈতন্য মহাপ্রভুর ঘুম ভাঙানোর জন্য রচিত গানগুলি আসলে সাধারণ মানুষের ঘুম ভাঙাতেই গাওয়া হয় বলে মনে করা হয়ে থাকে। কার্তিকে গ্রামের বাসিন্দারা কৃষি-সহ বিভিন্ন ধরনের কাজের চাপে থাকতেন। ভোর ভোর উঠে কাজ শুরু করতে হয়। তাই তাঁদের ঘুম ভাঙাতেই ওই গানের প্রচলন হয়েছিল। আবার রাতে লুট ঠেকাতে পাহারা দেওয়ার জন্য টহল গানের সূত্রপাত হয়েছিল বলেও কেউ কেউ মনে করেন।

লোক গবেষকেরা জানাচ্ছেন, নবান্নের দিন পর্যন্ত গান গাওয়ার পিছনেও যুক্তি আছে। কারণ জনশ্রুতি, ওই দিন নানা কাজের চাপের পাশাপাশি ধরিত্রী এবং পিতৃপুরুষকে নবান না করিয়ে খাওয়া যায় না। তাই বহু জায়গায় সূর্যোদয়ের আগে খেয়ে নেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। টহলের গান শুনে গৃহস্থরা ঘুম থেকে উঠে সেই প্রস্তুত শুরু করে দেন। মূলত আশ্রম, আখড়ার বৈরাগী বৈষ্ণবেরাই গ্রামে গ্রামে টহল গান গেয়ে বেড়াতেন। সাধনসঙ্গিনী, বৈষ্ণবীকে নিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় খোল, খঞ্জনী বাজিয়ে তাঁদের গ্রামে গ্রামে টহল দিয়ে বেড়াতে দেখা যেত। সাধনসঙ্গিনীর ভূমিকায় শিষ্যকেও দেখা গিয়েছে। কোথাও আবার গৃহী বৈষ্ণবেরাও পুরুষানুক্রমে টহল দিয়েছেন। নবানের দিন সিধে বা পারিশ্রমিক হিসেবে চাল, ডাল-সহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে মহোৎসবের আয়োজন করেছেন তাঁরা।

Advertisement

সেই ছবিটাই এখন হারাতে বসেছে। আখড়া, আশ্রমের সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। গ্রামে গ্রামে এখন সরকারি আনুকুল্যে একাধিক হরিনাম সংকীর্তনের দল গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও তারাই টহল দিতে শুরু করেছেন। এর ফলে যাঁরা পুরুষানুক্রমে টহল দিতেন তাঁরা, কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। লাভপুরের ডিঙারা গ্রামের ৫০ বছরের অনুজ দাস, নানুরের গোপালনগরের ৫২ বছরের সনাতন দাসবৈরাগ্যরা পুরুষানুক্রমে টহল দিয়ে আসছেন। তাঁরা বলেন, ‘‘অন্য গানের মতোই টহল গানের একটা গাওন রীতি আছে। গানের কলির শেষে একটা বিশেষ লম্বা টান দিতে হয়। বাপ, ঠাকুর্দাদের সঙ্গে টহল দিতে দিতে রীতিটা রপ্ত করতে হয়েছে। এখন যাঁরা টহল দিচ্ছেন তাঁরা ওই সব রীতির ধার ধারেন না।’’

সাহিত্যকর্মী আশিস মুখোপাধ্যায়, অসীম শীল, শিক্ষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরা বলেন, ‘‘আগে টহল গানের একটা আলাদা শ্রুতিমাধুর্য ছিল। ভোরে ঘুম ভেঙে গেলেও বিরক্ত লাগত না। বরং বিছানায় শুয়ে গানের সুর মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম। এখন আর সেই মাধুর্যটা খুঁজে পাই না।’’ লোকসংস্কৃতি গবেষক আদিত্য মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আগে যাঁরা টহল গান করতেন তাঁদের বৈষ্ণব পদাবলী সম্পর্কে জ্ঞান ছিল। তাই তাঁদের গানে যে শ্রুতিমাধুর্য পাওয়া যেত তা হাল আমলের টহল গায়কদের কাছে আশা করা যায় না। কারণ, গায়ক নিজে আত্মস্থ না হলে সুচারু ভাবে পরিবেশন করা সম্ভব নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন