রামপুরহাট পুরসভা: পুরভোটের মুখে ত্রিফলা বাতি খুলে নেওয়ায় বিতর্ক

বিদ্যুৎ বিল বাকি আড়াই কোটি

ঢাকঢোল পিটিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শহরে বসেছিল বাহারি ত্রিফলা পথবাতি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই বাতির অনেকগুলিই আঁধারে ঢেকেছিল। সেই ‘আঁধারে’র সঙ্গেই জুড়েছিল ত্রিফলা বাতির বিপুল বিদ্যুত্‌ বিলও। আসন্ন পুরভোটের মুখে গত বৃহস্পতিবার থেকে সাধের সেই ত্রিফলা বাতিস্তম্ভেরই একাংশ সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে রামপুরহাট পুরসভার পরবর্তী বোর্ডের উপরে প্রায় আ়়ড়াই কোটি টাকার বকেয়া বিলের বোঝা চাপিয়ে বিদায় নিচ্ছে চলতি তৃণমূল বোর্ড!

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৫ ০১:১৩
Share:

খুলে ফেলা হচ্ছে ত্রিফলা পথবাতি। —ফাইল চিত্র।

ঢাকঢোল পিটিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শহরে বসেছিল বাহারি ত্রিফলা পথবাতি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই বাতির অনেকগুলিই আঁধারে ঢেকেছিল। সেই ‘আঁধারে’র সঙ্গেই জুড়েছিল ত্রিফলা বাতির বিপুল বিদ্যুত্‌ বিলও। আসন্ন পুরভোটের মুখে গত বৃহস্পতিবার থেকে সাধের সেই ত্রিফলা বাতিস্তম্ভেরই একাংশ সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে রামপুরহাট পুরসভার পরবর্তী বোর্ডের উপরে প্রায় আ়়ড়াই কোটি টাকার বকেয়া বিলের বোঝা চাপিয়ে বিদায় নিচ্ছে চলতি তৃণমূল বোর্ড!

Advertisement

অথচ বিরোধী দলগুলি বারবারই এই ত্রিফলা বাতি বসানোর বিরোধিতা করে এসেছে। ঘটনা হল, শহরের এমন অনেক জায়গায় ওই পথবাতি বসানো হয়েছিল, যেখানে আগে থাকতেই ‘সোডিয়াম ভেপার লাইট’ বা ‘মেটাল হ্যালাইড’ আলোর ব্যবস্থা ছিল। আবার শহরের এমন অনেক প্রান্ত এখনও রয়ে গিয়েছে, যেখানকার রাস্তায় সরকারের আলো পৌঁছয়নি। সেই যুক্তিতেই বিদায়ী পুরসভার বিরোধী কাউন্সিলর, সিপিএমের সঞ্জীব মল্লিক বলছেন, ‘‘শহরে ত্রিফলা আলো বসানো মূলত জনগণের করের টাকায় একটি অর্থ অপচয়ী প্রকল্প। সেগুলির বেশির ভাগই অল্প দিনে খারাপ হয়ে যায়। এগুলি সঠিক ভাবে দেখাশোনা করার কোনও পরিকাঠামোও প্রশাসনের নেই। উপরন্তু বছরভর আকাশছোঁয়া বিদ্যুৎ বিল মেটাতে হয়!”

পুর প্রশাসন সূত্রের খবর, ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শহর সৌন্দর্যায়নের পরিকল্পনা মাফিক ২০১১ সালে ‘স্টেট আরবান ডেভলপমেন্ট এজেন্সি’ (সুডা) রাজ্যের অন্যান্য পুরসভার মতো রামপুরহাট পুরসভার জন্য ৫৭টি ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ বসিয়েছিল। তাতে খরচ হয়েছিল আনুমানিক ১৫ লক্ষ টাকা। পুরসভার ব্যাঙ্ক রোড এবং দেশবন্ধু রোডে যখন ত্রিফলা লাগানো হয়, তখন রাস্তায় ইতিমধ্যেই ‘সোডিয়াম ভেপার লাইট’ বা ‘মেটাল হ্যালাইড’ বাতি জ্বলত! বিজেপি-র জেলা সহ-সভাপতি তথা এ বার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে দলের প্রার্থী শুভাশিস চৌধুরী বলছেন, ‘‘এ যেন আলোর নীচেই আরও আলো! অথচ ওই মুহূর্তে পুরসভার ১, ৩, ৮, ৯, ১৫, ১৬ কিংবা ১৭ নম্বর ওয়ার্ডগুলি, যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পল্লি গড়ে উঠছে, সেই সব এলাকার বেশ কিছু এলাকার রাস্তায় আলো জ্বলত না।’’ তাঁর অভিযোগ, পুরসভায় এখনও কিছু এলাকা রয়েছে, যেখানে পথবাতি কেবল মাত্র ভোটের সময় জ্বলে। বাকি সময়ে পথবাতি নিয়ে পুরসভার কাছে বারবার দরবার করেও কোনও লাভ হয় না।

Advertisement

প্রশ্ন উঠেছে ত্রিফলা পথবাতির জন্য বিপুল বিদ্যুৎ খরচ নিয়েও। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বণ্টন সূত্রে জানা গিয়েছে, ত্রিফলা বাতিগুলি যখন লাগানো হয়, তখনই রামপুরহাট পুরসভার পথবাতি বাবদ বকেয়া বিলের পরিমাণ দেড় কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। ২০০৯ সালে বকেয়া বিল পরিশোধ না করার জন্য কিছু ক্ষণের জন্য শহরের একাংশের পথবাতির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। পরে পুরসভা থেকে কিছু টাকা পরিশোধ করা হলে বিদ্যুৎ সংযোগ ফেরে। এ দিকে, আজ যখন ওই ত্রিফলা বাতি খুলে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে, তখন বিদ্যুৎ খরচ বাবদ পুরসভার বকেয়া বিল কত? কোম্পানির বীরভূম রিজিওনাল ম্যানেজার তপন দে বলছেন, ‘‘রামপুরহাট পুরসভার বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি। বকেয়া টাকা শোধ করার জন্য পুরসভাকে নোটিসও করা হয়েছে।’’

এ দিকে, পুর এলাকায় ত্রিফলা পথবাতি প্রকল্পের খরচ কত, তা আবার জানেন না খোদ বিদায়ী পুরপ্রধানই। রামপুরহাটের বিদায়ী পুরপ্রধান অশ্মিনী তেওয়ারির বক্তব্য, ‘‘ত্রিফলা পথবাতি ‘স্টেট আরবান ডেভলপমেন্ট এজেন্সি’ পুর দফতরের বর্ধমান বিভাগীয় বাস্তুকার দফতর থেকে কলকাতার এক ঠিকাদার সংস্থার মাধ্যমে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। পুরসভা থেকে ওই টাকা খরচ হয়নি। যার জন্য কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’’ এমনকী, পুরসভার ওই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ বিলও বাকি নেই বলে অশ্মিনীবাবুর দাবি। তিনি বলছেন, ‘‘পুরসভার রাস্তা এবং পানীয় জল সরবরাহ বাবদ বড় জোর ৭০-৮০ লক্ষ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানিই ভুল বিল পাঠিয়েছে। আমরা তা দফতরকে জানিয়েও দিয়েছি।’’ যদিও রামপুরহাট পুরসভার বিদায়ী বোর্ডের এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলেই জানিয়েছে বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি।

অন্য দিকে, ওই ত্রিফলা পথবাতি খুলেই শহরের গাঁধী পার্ক এলাকায় বসানোর কাজ চলছে। পুরপ্রধান বলছেন, ‘‘দেশবন্ধু রোডের বাতিগুলি গাঁধী পার্ক সৌন্দর্যায়নের কাজে লাগানো হচ্ছ। ব্যাঙ্ক রোডের বাতিগুলি থাকবে।’’ পুরপ্রধানের ওই বক্তব্যের খেই ধরেই বিরোধীরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও তুলতে শুরু করেছেন। নির্বাচনী বিধি জারি থাকা সত্ত্বেও কোন আইনের বলে এই ‘সৌন্দর্যায়নে’র কাজ চলছে? অশ্বিনীবাবুর যুক্তি, ‘‘পুরসভার শ্রমিকেরা তো ওই বাতি খুলছেন না। ঠিকাদার সংস্থার শ্রমিকেরা এই কাজ করছেন।” উল্টো দিকে, এক জায়গার বাতিস্তম্ভ তুলে অন্য জায়গায় বসানোর এই কাজকে ‘সৌন্দর্যায়ন’ বলে মানতে নারাজ পুরসভার প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা রামপুরহাট মহকুমাশাসক উমাশঙ্কর এস। তাঁর দাবি, ‘‘এ তো মেরামতির কাজ চলছে!’’

ঘটনা হল, প্রথম থেকেই ত্রিফলা পথবাতি নিয়ে ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের একাংশ আপত্তি তুলেছিলেন। ওই বাসিন্দাদের বক্তব্য, এই শহরের রাস্তা বেশ সঙ্কীর্ণ। ফুটপাতই যখন বেদখল হয়ে গিয়েছে, সেখানে রাস্তার বেশ খানিকটা ‘দখল’ করে ত্রিফলা বাতি বসানো যুক্তিসঙ্গত ছিল না। এ ছাড়াও ওই বাতির স্থায়িত্ব নিয়েও যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘কয়েক মাস পর থেকেই ওই বাতির হাল খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনও স্তম্ভে ত্রিফলার তিনটি বাতির দু’টি খারাপ, কোনওটায় তিনটিই খারাপ। কোথাও আবার ঢাকনা ভেঙে উধাও বাতি! সৌন্দর্যায়নের সঠিক রূপ ফুটল কোথায়?’’

আসন্ন ভোটেই এর উত্তর খুঁজবে রামপুরহাট। এমনটাই আশা করছে বিরোধী দলগুলি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন