চলে গিয়েছে সার্কাসের দল। শিকল পায়ে শহরেই রয়ে গিয়েছে ওরা। ছবি: সুজিত মাহাতো।
যে তাঁবুর নীচে তারা জনতাকে মুগ্ধ করে রাখত, সেই তাঁবু চলে গিয়ে অন্য শহরে। চলে গিয়েছে সঙ্গীরাও। খোলা আকাশের নীচে পায়ে দড়ি বা শিকলবাঁধা অবস্থায় রয়ে গিয়েছে শুধু তারা তিনজন।
পুরুলিয়ার রাঁচি রোডের চার্চ লাগোয়া ময়দানে তাই পদ্মা, লছমি ও চন্দ্রাকে দেখতে এখন ভিড় জমাচ্ছেন ছেলে-বুড়ো সকলেই। এতদিন শহরের যে অতিথিদের দেখতে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হতো, এখন তাদের দেখা মিলছে বিনা পয়সাতেই।
শীতের শুরুতে এই মাঠেই সার্কাসের তাঁবু পড়েছিল। পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলের জেরে চলতি মরসুমে তেমন ভিড় হয়নি। এরই মধ্যে সেন্ট্রাল জু অথরিটির একটি নির্দেশে, ওই সার্কাসে হাতির খেলা দেখানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পুরুলিয়া থেকে কয়েকদিন আগে সার্কাসের তাঁবু উঠে গিয়েছে মেদিনীপুরে। সেখানে চলে গিয়েছে ম্যাকাও, টিয়া, কুকুর, ঘোড়া, কাকাতুয়ারা। পুরুলিয়ায় পড়ে রয়েছে পদ্মা, লছমি ও চন্দ্রা।
অথচ ক’দিন আগেও দর্শকের মাঝে অ্যাকোডিয়ানের সুরে আলো ঝলমল পরিবেশে সার্কাসের এরিনায় সাজসজ্জা করা এই পদ্মা, লছমি ও চন্দ্রাই শুঁড়ে ব্যাট ঝুলিয়ে গ্যালারিতে বল পাঠিয়েছে। নিখুঁত কিকে বলকে জালে জড়ানো, শুঁড়ে বালতি ঝুলিয়ে জল ঢেলে, নারকেল ফাটিয়ে ও ঘণ্টা বাজিয়ে গণেশ পুজো করে দর্শকদের আনন্দও দিয়েছে। কিন্তু এখন তারা কর্মহীন। গাছতলায় দিনভয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কখনও বা একজন অন্যের মাথায় শুঁড় বুলিয়ে দিচ্ছে।
এই জেলার জঙ্গললাগোয়া এলাকায় মাঝেমধ্যে বনের হাতি ঢুকে পড়লেও পুরুলিয়া শহরে খোলা আকাশের নীচে দিনভর হাতি দেখার সুযোগ হয় না। তাই সকাল-বিকেল যে যখন সময় পাচ্ছেন, ঘরে ছোট বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে হাতি দেখিয়ে আনছেন। আমডিহার বাসিন্দা মীরা মাহাতো ছেলেকে নিয়ে হাতি দেখতে এসেছিলেন। বললেন, ‘‘এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সার্কাসে দেখা হাতিগুলো রয়েছে দেখে ছেলে অভয় আবদার করল। তাই দাঁড়িয়ে গেলাম।’’ বাবার হাত ধরে এসেছে আর এক খুদে তৃষিক কুণ্ডু। ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা দিলু সিং ঘাটোয়াল, বিভাস দাস।
সার্কাস কর্তৃপক্ষ ও বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৭ ডিসেম্বর সেন্ট্রাল জু অথরিটি জানিয়েছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২ অনুযায়ী ৩৮ এইচ (৬) ধারায় হাতির খেলা দেখানো বন্ধ। সার্কাসের হাতিরা কী অবস্থায় রয়েছে তা সরজমিনে দেখতে সেন্ট্রাল জু অথরিটি অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্য, বন দফতরের পদস্থ আধিকারিকদের সার্কাস পরিদর্শনে পাঠায়। তাঁদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই আপাতত হাতিদের খেলা দেখানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
বছর পনেরো আগে বিহারের শোনপুর থেকে হাতিগুলিকে আনেন সার্কাস কর্তৃপক্ষ। এখন ওই হাতিদের দেখাশোনা করছেন মাহুত আহমেদ মিঞা। তিনিই গাছের ডালপাতা জোগাড় করে এনে পদ্মা, লছমি ও চন্দ্রার মুখে ধরছেন। তিনি বলেন, ‘‘দলের বাইরে ওদের মন ভাল নেই।’’
মাঝে মধ্যে খোঁজখবর নিতে আসছেন সার্কাসের ম্যানেজার জয়রাজ। তিনি বলেন, ‘‘আবার যাতে ওরা খেলা দেখাতে পারে সে জন্য আবেদনের রাস্তা রয়েছে। ওরা আমাদের এতদিনের সঙ্গী। পথে তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।’’