‘সোনাদা’ আর নেই, মনখারাপ সিউড়ির

বাম জমানায় বারবার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলেছিলেন তিনি। লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে কখনও লণ্ঠন হাতে, কখনও কাঁদরে সেতুর দাবিতে খালি গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বিধানসভায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

সিউড়ি শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:৪৬
Share:

তখন মন্ত্রী। —ফাইল চিত্র।

বাম জমানায় বারবার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলেছিলেন তিনি। লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে কখনও লণ্ঠন হাতে, কখনও কাঁদরে সেতুর দাবিতে খালি গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বিধানসভায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

Advertisement

সত্তরের দশকে বিধানসভায় জ্যোতিবাবুদের বিরুদ্ধে বিরোধীদের ‘শাউটিং স্কোয়াডে’র অন্যতম মুখ সুনীতি চট্টরাজ প্রয়াত হলেন। বীরভূমের মানুষের কাছে যিনি ‘সোনাদা’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। সোমবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিট নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার সল্টলেকের বাড়িতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৭৮।

দীর্ঘ দিন ধরে পক্ষাঘাতে ভুগছিলেন সুনীতিবাবু। বর্তমানে তাঁর ছেলে আমেরিকায় ও মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ২০১১ সালে স্ত্রী রুনাদেবী প্রয়াত হয়েছেন। সল্টলেকের বৈশাখী আবাসনে নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছিলেন। সেখানে দুই মহিলা কর্মী অসুস্থ সুনীতিবাবুর দেখভাল করতেন। দিন কয়েক ধরে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিল তাঁর। আমেরিকা থেকে রওনা দিয়েছেন ছেলে ভাস্কর। বুধবার তাঁর এ দেশে পৌঁছনোর কথা।

Advertisement

সোনাদা আর নেই, এ খবর জানাজানি হতেই এ দিন দ্রত মনখারাপ নেমে আসে সিউড়ি শহরে। স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর সংস্পর্শে থাকা মানুষ জন।

যুব অবস্থা থেকে কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুনীতিবাবু। প্রথম জীবনে পেশায় ছিলেন আইনজীবী। ১৯৭১ সালে সিউড়ি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে লড়ে বাম প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পরের বছরই মধ্যবর্তী নির্বাচনে জিতে তাঁর সমালোচকদের উচিত জবাব দিয়েছিলেন সোনাদা। মাত্র ২৮ বছর বয়সী সুনীতিকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। বিদ্যুৎ, সেচ ও জলপথ দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনিই হয়েছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্করবাবুর মন্ত্রিসভার অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য। এর পরে ’৭৭ ও ’৮২ সালেও তিনি জয়ী হয়েছিলেন। বাম আমলের মধ্য গগনে ’৮৭ ও ’৯১ সালে পরপর দু’বার তিনি সিপিএমের তপন রায়ের কাছে হেরে যান। যদিও সেই তপনবাবুকেই হারিয়ে ফের ফিরে আসেন ’৯৬-এ। ২০০১ সালে যদিও সিপিএমের ব্রজ মুখোপাধ্যায়ের কাছে তাঁকে হারের মুখ দেখতে হয়।

নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা। নিজস্ব চিত্র।

জনপ্রিয়তা যেমন ছিল, তাঁর বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে বিতর্কও কোনও অংশে কম ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় (বিরোধীদের দাবি ছিল, একটি কারখানা তৈরির সময়ে প্রভাব খাটিয়ে এক আত্মীয়কে তিনি প্রচুর টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ পাইয়ে দিয়েছেন) ওয়াংচু কমিশন গঠিত হয়। সিদ্ধার্থশঙ্করবাবু তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। এলাকার মানুষ অবশ্য বলছেন, ‘‘দুর্নীতি কোথায় কী, জানা নেই। তবে এটা ঠিক, এলাকার বহু তরুণ তরুণীকে বিভিন্ন দফতরে তিনি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।’’

১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে পদত্যাগ করে ১৯৯৮ সালে পুরনো দল ছেড়ে নবগঠিত তৃণমূলে যোগ দেন সুনীতিবাবু। পরের নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে লড়ে অবশ্য সিপিএমের কাছে হেরে যান পোড়খাওয়া ওই রাজনীতিক। তাঁর ছেড়ে যাওয়া আসনে কংগ্রেস থেকে দাঁড়িয়ে ২০০৬ সালে জেতেন স্বপনকান্তি ঘোষ। ওই বছরই ১২ জানুয়ারি একটি দুর্নীতির মামলায় তৃণমূলের প্রদেশ সহ-সভাপতির পদে থাকা সুনীতিবাবুকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। ২০০৩ সালে আয় বহির্ভূত সম্পত্তির একটি মামলায় কাঞ্চনকুমার সান্যাল নামে এক শুল্ক অফিসারের বাড়িতে হানা দিয়ে প্রায় ৮৮ লক্ষ টাকা বাজেয়াপ্ত করেছিল সিবিআই। ওই বাজেয়াপ্ত টাকা তাঁর এবং তিনিই তা কাঞ্চনবাবুর কাছে রেখেছিলেন, হাইকোর্টে দাবি করেছিলেন সুনীতিবাবু। তিন বছর পরে ভুয়ো তথ্য দিয়ে ওই অফিসারকে আড়াল করার চেষ্টার অভিযোগে সিবিআই দু’জনকেই গ্রেফতার করেছিল।

সুনীতিবাবুর জীবনে আরও বড় আঘাত নেমে আসে ২০১১ সালে। তাঁকে টিকিট না দিয়ে কংগ্রেস ছেড়ে দলে যোগ দেওয়া স্বপনবাবুকে বিধানসভায় টিকিট দেয় তৃণমূল। তা মানতে পারেননি সোনাদা। অভিমানে নির্দল প্রার্থী হয়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের মন থেকে সরে যাননি। অসুখ বিসুখ থেকে যে কোনও প্রয়োজনে তাঁকে হাতের কাছে পেয়েছেন বীরভূমের মানুষ। বহু রোগীকে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করে নিজে গিয়ে দেখাশোনা করতেন। টাকাপয়সাও দিতেন। তৃণমূলের সিউড়ি ১ ব্লক সভাপতি স্বর্ণময় সিংহ বলছেন, ‘‘সোনাদা আমার অন্নদাতা। ওঁর জন্যই স্কুলে শিক্ষক পদে আমার চাকরি হয়েছিল। রাজনীতিতে হাতে খড়িও ওঁরই হাতে। ২০১১ সালে রাজনৈতিক ভাবে দূরত্ব তৈরি হলেও ওই মানুষটির সঙ্গে অন্তরের সম্পর্ক কোনও দিন যাওয়ার নয়।’’

তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত জেলার বহু মানুষই। সিউড়িতেই তাঁর দেহের সৎকার হোক— শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে চান সোনাদার অনুগামীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন