ফিরেছে গণেশ, চিন্তায় ছিল সমীরণ

ঘটনাটি প্রায় এক বছর আগের। পুলিশ ভুলে গিয়েছে। কিন্তু, এখনও স্পষ্ট মনে আছে মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বা এমটিপিএসের বহু ঠিকা শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

গঙ্গাজলঘাটি শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৬ ০২:৪২
Share:

ঘটনাটি প্রায় এক বছর আগের। পুলিশ ভুলে গিয়েছে। কিন্তু, এখনও স্পষ্ট মনে আছে মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বা এমটিপিএসের বহু ঠিকা শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের। এমটিপিএসের ছাই পুকুরের ফেনা অবৈধ ভাবে কে তুলবে, তা নিয়ে গঙ্গাজলঘাটির দুর্লভপুর লেভেল ক্রসিংয়ে হকি স্টিক নিয়ে মারপিটে জড়িয়েছিল দুই সমাজবিরোধী গোষ্ঠী।

Advertisement

এলাকাবাসী জানাচ্ছেন, ওই দুই দলের একটির নেতৃত্বে ছিলেন রবিবার রাতে খুন হওয়া গণেশ সূত্রধর। অন্য সমাজবিরোধী গোষ্ঠীর নেতা গণেশ-হত্যায় মূল অভিযুক্ত সমীরণ গরাই। সোমবার লাগাপাড়া মোড়ের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে এমটিপিএসের একাধিক ঠিকা শ্রমিক সেদিনের স্মৃতি আওড়ে জানান, মারতে মারতে গণেশকে প্রকাশ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়ে সমীরণ বলেছিল, প্রাণে বাঁচতে চাইলে তাঁকে এলাকা ছাড়তে হবে। সেই থেকে এলাকায় অনেক দিন টিকি দেখা যায়নি গণেশের। তখন এমটিপিএস সংলগ্ন অঞ্চলে দাপাদাপি বাড়ে সমীরণের।

কিন্তু, বিধানসভা ভোটের প্রচার শুরুর গোড়ায় ফের গণেশকে নতুন রূপে এলাকায় দেখা গেল। তৃণমূল প্রার্থী তথা শালতোড়ার বিধায়ক স্বপন বাউরির প্রচারগাড়ির ভিতরে বসে জনা কয়েক শাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন গণেশবাবু। ঘটনাচক্রে নিহত গণেশকে তৃণমূলকর্মী বলে দাবি করেছেন বিধায়কও। অভিযোগ, রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় গত চার মাসে নিজের হারানো জমি ধীরে ধীরে ফিরে পেতে সক্রিয় হয়েছিলেন গণেশ। সেটাই তাঁর কাল হল বলে তদন্তকারী এবং এলাকাবাসীর ধারণা।

Advertisement

ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, গণেশ ফিরে আসতেই প্রমাদ গুনতে শুরু করে সমীরণ-গোষ্ঠী। গণেশ চলে আসায় এমটিপিএসের ঠিকাদারদের কাছ থেকে তোলবাজির রাজত্ব ফের ভাগ হয়ে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করতে শুরু করেন সমীরণ। এলাকাবাসীরও দাবি, এলাকায় ফিরেই এমটিপিএসের ঠিকাদারদের উপর ফের জুলুমবাজি শুরু করেছিলেন গণেশ। ঠিকা সংস্থায় তাঁর নিজের পছন্দের লোককে কাজ পাইয়ে দিতে শুরু হয়েছিল গণেশের হুমকি ফোন আসা। চলছিল তোলা আদায়ও। বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, গণেশের নিয়তির লিখন বোধহয় তখনই স্থির হয়ে গিয়েছিল! গণেশের সৌজন্যে তোলার ভাগে কোপ পড়া মোটেও ভাল চোখে দেখেননি সমীরণ। যার পরিণামে তলায় তলায় দু’তরফে সংঘাত বা়ড়ছিল। ‘‘শেষ অবধি গণেশকে মরতেই হল! এবং নৃশংস ভাবে।’’—মঙ্গলবার বলছিলেন ওই পুলিশকর্তা।

রবিবার রাতে মোটরবাইকে তাঁর সব সময়ের সঙ্গী পাকতোড়ের বাসিন্দা ঝন্টু গরাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন গণেশ। লাগাপাড়ার গলিতে ঢোকার পরেই সমীরণ ও তাঁর দলবলের সামনে পড়ে যান তাঁরা। অভিযোগ, হকি স্টিক দিয়ে গণেশ ও ঝন্টুকে বেধড়ক মারধর করে সমীরণ ও তাঁর দলবল। ঝন্টু পালিয়ে যান। গণেশকে পরে বোমা ও গুলিতে মারা হয়। সমীরণ সেই থেকে পলাতক। ধরা পড়েছেন তাঁর বাবা এবং তিন শাগরেদ। ওই তিন জনকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে কখনও মুখোমুখি বসিয়ে, কখনও বা আলাদা আলাদা ভাবে তদন্তকারীরা লাগাতার জেরা করে চলেছেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, সমীরণ বছর সাতেক আগে ধাপে ধাপে এমটিপিএসকে কেন্দ্র করে চলতে থাকা দুষ্কৃতী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এক রাজনৈতিক নেতার হাত ধরে এমটিপিএসে ঠিকা শ্রমিকদের নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে সামিল হতেন বছর আঠাশের ওই যুবক। ধীরে ধীরে ঠিকা সংস্থাগুলিকে চাপ দিয়ে নিজের মনমতো কর্মী নিয়োগ শুরু করেন সমীরণ। ঠিকা সংস্থার আধিকারিকদের মারধরের অভিযোগও উঠতে থাকে তাঁর বিরুদ্ধে। এলাকার যুবকদের একাংশের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়তেই শুরু হয় তোলাবাজিতে হাত পাকানোও। থানায় পরের পর অভিযোগ জমা পড়তে শুরু করে সমীরণের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কখনওই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেনি।

অভিযোগ, শুধু এমটিপিএসের ঠিকা সংস্থাগুলির কর্তারাই নন, সমীরণের দাপটে ভয়ে থাকেন এলাকার ছোট-মাঝারি দোকানিরাও। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, সমীরণের বাড়বাড়ন্তের পিছনে রয়েছে বাঁকুড়ার এই শিল্পাঞ্চলের এক বড় মাফিয়া। কার্যত সেই হয়ে ওঠে সমীরণের ‘গডফাদার’। পুলিশের দাবি, এলাকায় খুন, বন্দুকবাজির মতো একাধিক ঘটনায় ওই মাফিয়ার হাত রয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ এখনই তার নাম প্রকাশ করতে চাইছে না। এক পুলিশ কর্তা বলেন, “সবার আগে আমরা সমীরণকে ধরতে চাই। তার পর কান টানলেই মাথা আসবে।’’

স্বাভাবিক ভাবেই সমীরণের এই দাপটের সাম্রাজ্য পথের কাঁটা ছিলেন গণেশ। ফলে, তোলাবাজি নিয়ে ওই দুই দলের ঝামেলা লেগেই থাকত। কিন্তু, রবিবার রাতের ঘটনার পরে লাগাপাড়ার বাসিন্দারাও স্তম্ভিত! এলাকার এক যুবক এ দিন বলছিলেন, “দুষ্কৃতীরা নিজেদের মধ্যে প্রায়ই ছোটখাটো ঝামেলা করে। কিন্তু এত বড় হত্যাকাণ্ড আমাদের ঘরের সামনে ঘটে গেল, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’’ স্থানীয় মানুষের দাবি, এই সব রুখতে পুলিশ সক্রিয় হোক। রাতে এলাকায় পুলিশি টহল বাড়ানো হোক। সেই সঙ্গে দাবি উঠছে এমটিপিএসের তোলাবাজ চক্রের পান্ডাদের গ্রেফতারেরও।

এমটিপিএস সূত্রেই জানা যাচ্ছে, গণেশ, সমীরণ একা নন। অন্তত আট- দশটি দুষ্কৃতী চক্র সক্রিয় রয়েছে এমটিপিএসে। সম্প্রতি তৃণমূলের লটিয়াবনি অঞ্চল সভাপতি নিমাই মাজি পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন এমটিপিএসে অবৈধ ভাবে টাকা তোলার একটি চক্রকে নিয়ে। নিমাইবাবুর অভিযোগ, এমটিপিএসের কাঁচামাল পরিবহণকারী গাড়িগুলিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ নম্বর গেটে আটকে টাকা তুলছে একদল দুষ্কৃতী। টাকা না দিলে গাড়ি গুলিকে আটকে রাখা হচ্ছে। এমটিপিএস কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। নিমাইবাবু বলেন, “ওই গেটে প্রকাশ্যেই তোলাবাজি হচ্ছে। বিষয়টি আমার নজরে আসতেই পুলিশকে জানিয়েছি। শিল্পের স্বার্থেই এমটিপিএসে দুষ্কৃতীচক্র রোধ করা দরকার বলে আমার মনে হয়েছে।’’

জেলা পুলিশের দাবি, দুষ্কৃতীদের ধরতে তারা সক্রিয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে চান না কেউ। এর ফলে সমস্যা হয়। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘সর্বস্তরের মানুষ ও এমটিপিএস কর্তৃপক্ষ এই সবের বিরুদ্ধে রখে দাঁড়ালে পুলিশের সুবিধা হবে।’’ এমটিপিএসের এক পদস্থ আধিকারিকের বক্তব্য, “পুলিশের কাছে গিয়েও সমস্যার সমাধান যে হবে তার ভরসা কোথায়? প্রকাশ্যে মুখ খুললে পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে কিনা, সেই নিশ্চয়তাও তো নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন