চাঁদা দিচ্ছেন শ্যামা, নিচ্ছে আমি-তুমি

কমিটির অস্তিত্বই নেই। অথচ পুজোর নামে বিল বই নিয়ে পথ আটকে দিব্যি চলছে চাঁদা তোলা! শুধু বড়রাই নয়, ছোট-ছোট ছেলেরাও হইহই করে হাইওয়েতে গাড়ি থামিয়ে কালীপুজোর নামে টাকা তুলছে! সাদা পোশাকে রাস্তায় চাঁদা শিকারিদের ধরপাকড় করতে নেমে এই রকম ঘটনা দেখে তাজ্জব হয়ে গেলেন বিষ্ণুপুরের পুলিশ আধিকারিকেরা।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৪৭
Share:

মেটেপাতন গ্রামে উদ্ধার হওয়া বিল।

কমিটির অস্তিত্বই নেই। অথচ পুজোর নামে বিল বই নিয়ে পথ আটকে দিব্যি চলছে চাঁদা তোলা! শুধু বড়রাই নয়, ছোট-ছোট ছেলেরাও হইহই করে হাইওয়েতে গাড়ি থামিয়ে কালীপুজোর নামে টাকা তুলছে! সাদা পোশাকে রাস্তায় চাঁদা শিকারিদের ধরপাকড় করতে নেমে এই রকম ঘটনা দেখে তাজ্জব হয়ে গেলেন বিষ্ণুপুরের পুলিশ আধিকারিকেরা।

Advertisement

সোমবার আনন্দবাজারে বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়ায় পুজোর নামে গাড়ি আটকে কী ভাবে জবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে, সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পুলিশ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ভুক্তভোগীরা। খবর প্রকাশের পরেই এ দিন বিষ্ণুপুরের এসডিপিও লাল্টু হালদার পুলিশ কর্মীদের নিয়ে পথে নেমে জোর করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেন। বিষ্ণুপুর মহকুমার বিভিন্ন থানা এলাকাতেও পুলিশ কর্মীরা চাঁদা শিকারিদের
ধরপাকড় করলেন।

এসডিপিও বলেন, “রাস্তায় গাড়ি আটকে জোর করে চাঁদা তোলায় এ দিন মোট ১৪ জনকে তুলে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ জন নাবালক হওয়ায় মুচলেকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ তিনি জানান, এই অভিযান পুরো বিষ্ণুপুর মহকুমা জুড়ে চলবে।

Advertisement

এ দিন সকালে এসডিপিও নিজে ও তাঁর রক্ষীরা সাদা পোশাকে একটি গাড়ি ওঠেন। সেই গাড়ির সামনে থেকে ‘পুলিশ’ লেখা বোর্ড খুলে নেওয়া হয়। ওই গাড়ির বেশ খানিকটা পিছনে রাখা হয় পুলিশের একটি ভ্যান। তারও পিছনে ছিল প্রিজন ভ্যান। ফলে চাঁদা শিকারিরা ধরতেই পারেনি, ওই গাড়িতে এসডিপিও রয়েছেন। চাঁদার জন্য তাঁর গাড়ি আটকাতেই বেরিয়ে আসে পুলিশের আসল মূর্তি।

দুই চাঁদা আদায়কারীকে ধরে নিয়ে আসছেন বিষ্ণুপুরের এসডিপিও।—নিজস্ব চিত্র

তাঁরা প্রথমে বিষ্ণুপুর-মেদিনীপুর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বেরোন। ওই রাস্তা ধরে বাঁকাদহ কুষ্ঠ কলোনির সামনে দিয়ে তাঁর গাড়ি যখন পার হচ্ছিল, তখনই একদল ছেলে লাল্টুবাবুর গাড়ি আটকায়। লাল্টুবাবু গাড়ির ভিতর থেকেই তাদের পুজো কত দিনের পুরনো, কোথায় হয় ইত্যাদি জানতে চাইলে তারা চটে যায়। ততক্ষণে পিছনে থাকা পুলিশের ভ্যানটি সেখানে এসে পৌঁছয়। পুলিশ দেখেই ওই ছেলেপুলেরা সটান জমির আলপথ ধরে দৌড়তে শুরু করে। ধাওয়া করেন লাল্টুবাবু ও পুলিশ কর্মীরা। অনেকে পালাতে পারলেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় দিলীপ গোস্বামী ও গঙ্গাধর শর্মা নামের দুই যুবক।

পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে, গঙ্গাধর বিষ্ণুপুর শহরের তুঁতবাড়ি এলাকার বাসিন্দা হলেও দিলীপের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া এলাকায়। বিষ্ণুপুরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। লাল্টুবাবুর দাবি, ‘‘কালীপুজোর নামে চাঁদা তুলে টাকা কামানোর উদ্দেশ্যেই দিলীপ শ্বশুরবাড়িতে এসেছে বলে আমাদের জানিয়েছে। আসলে পুজোর নামে চাঁদা তোলাটা এদের কাছে মরসুমি পেশার মতো। আদপে কোনও কালীপুজোই ওরা করছে না।” একই অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে বিষ্ণুপুর শহরের রাজ দরবার ও সঙ্কটতলা এলাকায়। সোনামুখী যাওয়ার পথে জয়রামপুরেও নাবালকদের পুজোর নাম করে ভুয়ো বিলবই নিয়ে চাঁদা তুলতে দেখা গিয়েছে বলে
লাল্টুবাবু জানিয়েছেন।

বিষ্ণুপুর শহরেও অনেক জায়গা থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ তুলেছিলেন পর্যটকেরা। তাঁদের অভিযোগ যে সত্যি, তা এ দিন দরবার এলাকা ও সঙ্কটতলায় গিয়ে পুলিশ দেখতে পায়। মোট চারজনকে সেখান থেকে ধরা হয়।

সোনামুখী যাওয়ার পথে বিষ্ণুপুরের জয়রামপুর এলাকায় কয়েক জন নাবালক চাঁদা চেয়ে এসডিপিও-র গাড়ি আটকায়। লাল্টুবাবু গাড়ি থেকে নেমে তাদের কাছে পুজো কমিটির নাম, সম্পাদকের নাম, কত বছর ধরে পুজো হচ্ছে— এ সব জানতে চাওয়ায় ছেলেগুলি রেগে যায়। একজন উল্টে বলে ওঠে— ‘‘এত জেনে আপনার লাভ কী? ২০ টাকা চাঁদা দিন, তারপর চলে যান।” এরমধ্যে হঠাৎ উর্দিধারী এক পুলিশ কর্মীকে দেখতে পেয়েই ভয় পেয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড় মারে ওই ছেলেরা। তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এগিয়ে আসেন ছেলেগুলির মায়েরা। তাঁরা রীতিমতো এসডিপিও-র সঙ্গে বচসা জুড়ে দেন। তাঁদের যুক্তি, পুজোর সময় রাস্তায় চাঁদা তোলার মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই। লাল্টুবাবু তখন তাঁদের বোঝান, এটা বেআইনি কাজ। ফের যদি তারা রাস্তায় চাঁদা তুলতে নামে, এবং তাদের বাড়ির লোকেরা সমর্থন করে, তবে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়ে দেন এসডিপিও।

সোনামুখী যাওয়ার পথে একই ভাবে বিষ্ণুপুরের রাধানগর ও সোনামুখীর বিভিন্ন জায়গায় ওই পুলিশ কর্তার গাড়ি আটকায় চাঁদা আদায়কারীরা। সোনামুখী থানা এলাকা থেকে আটক করা হয় তিনজনকে। পাত্রসায়র থানা এলাকায় ঢুকেও গ্রেফতার করা হয় মহাদেব রুইদাস ও শিবু রুইদাসকে। চাঁদা আদায়ের অভিযোগে পাত্রসায়র ও কোতুলপুর থানার পুলিশও কয়েকজনকে আটক করেছে।

অভিযান সেরে এসডিপিও যখন বিষ্ণুপুরে ফিরছিলেন, সেই সময় মেটেপাতন গ্রামে ফের একদল নাবালক চাঁদা চেয়ে তাঁর হাতে স্লিপ ধরিয়ে দেয়। সেই স্লিপে লেখা আদায়কারীর নাম ‘আমি’, সম্পাদকের নাম ‘তুমি’! আর চাঁদাদাতার নামের জায়গায় লেখা, ‘শ্রী শ্যামাপুজো’। সেই বিলবই আটক করে নিয়ে আসেন তিনি। ‘পুলিশ-জুজু’তে থমকাবে চাঁদাবাজেরা? না কি রাস্তায় লোকজনকেই থামাবে তারা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন