স্বপ্নাদেশে শুরু বিলকান্দির পুজো

পরিবারের আর্থিক অনটন সামলে কী ভাবে হবে মায়ের পুজো? স্বপ্নাদেশে সেই সমস্যা মেটালেন দেবী-ই। নির্দেশ মতোই ফুল আর জল দিয়ে পুজো শুরু হল। সালটা ১৯৪১।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

রাজনগর শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:০০
Share:

বনেদি: জগদ্ধাত্রী। নিজস্ব চিত্র

গ্রামেই দুর্গাপুজো। অষ্ঠমীর দিন সেখানে পুজো দিতে যাচ্ছিলেন তরুণী নিভাননী। কিন্তু, বাড়ি থেকে বেরিয়েই হঠাৎ কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তিনি। শুনতে পেলেন, কে যেন বলছে, ‘ওরে পুজো দিতে বাইরে কেন, আমি তো বাড়িতেই রয়েছি’। সম্বিৎ ফিরল নিভাননীর। চকিতে মনে পড়ে গেল বাবা বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে ওঁর শুরু করা জগদ্ধাত্রী পুজো তো দীর্ঘ দিন বন্ধ।

Advertisement

কিন্তু, পরিবারের আর্থিক অনটন সামলে কী ভাবে হবে মায়ের পুজো? স্বপ্নাদেশে সেই সমস্যা মেটালেন দেবী-ই। নির্দেশ মতোই ফুল আর জল দিয়ে পুজো শুরু হল। সালটা ১৯৪১। বীরভূমের রাজনগর লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের বিলকান্দি গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায়দের সেই পারিবারিক পুজোই এখন এলাকার বড় উৎসব।

রবিবার জগদ্ধাত্রীর মন্দিরে বসে পুজো শুরুর পারিবারিক ইতিহাসের কথাই শোনাচ্ছিলেন নিভাননীর ভাইপো, দেবীদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়রা। ওঁদের কথায়, ‘‘আমরা আদতে বর্ধমানের মেমারি লাগোয়া বিজুর গ্রামের বাসিন্দা। বহু কাল আগে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করতে ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রাম বিলকান্দিতে এসেছিলেন ঠাকুর্দা বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজো শুরু করেন তিনিই। মাত্র ৪০ বছরে ওঁর মৃত্যুর পর পুজো বন্ধ ছিল। মেজোপিসি নিভাননীর স্বপ্নাদেশের পরেই ফের শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পুজো।’’

Advertisement

বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন ছেলে (যাঁদের সকলেই প্রয়াত) সনৎকুমার, গোপালচন্দ্র এবং গিরিজাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়দের বংশধরদের উপরেই পুজোর দায়িত্ব। দেবীদাসবাবুরা বলছেন, ‘‘বিলকান্দি গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকেন না। সকলেই কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গে এবং ভিনং রাজ্য থাকলেও জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় সকলে ফেরেন গ্রামের ভিটেয়। পর্যায়েক্রমে দায়িত্ব থাকে পুজোয়। তবে আনন্দে সামিল পরিবারের সকলেই।’’

শুধু ইতিহাস নয়। পুজো আঙ্গিক, প্রতিমাতেও ভিন্‌স্বাদের বিলকান্দির জগদ্ধাত্রী। ‘বাল-অর্ক’ অর্থাৎ নবীণ সূর্যের লাল রঙের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দেবীর গায়ের রঙও লাল। সিংহবাহিনী দেবীর দু’দিকে দুই মুনি। এক দিকে নারদ, অন্য দিকে সনক। চার দিন ধরে নয়, এক দিনেই সম্পন্ন হয় দেবীর সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী পুজো। পর দিন দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনকে ঘিরে বসে মেলা। রবিবারই ছিল নবমী তিথি। নবপত্রিকা আনা সপ্তমী, অষ্টমী থেকে নবমীর কুমারী পুজো। সকাল থেকে রাত গড়িয়ে যায়। চলে দফায় দফায় খিচুড়ি, অন্ন থেকে লুচি-পায়েস নানা পদের ভোগ রান্না। সব নিয়ে ব্যস্ত পরিবারের মহিলারা। রবিবার সকালে মন্দিরে সপ্তমী চলাকালীন নানা কাজে ব্যস্ত পরিবারের বধূ লক্ষ্মী বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়রা। তাঁরা বলছেন, ‘‘সারা বছর উদগ্রীব হয়ে থাকি এই সময়টার জন্য। দারুণ কাটে পুজো। উপরি পাওনা সকলের সঙ্গে দেখা হওয়া।’’

শুধু পরিবারের লোকেরা নন। পুজো দেখতে ঢল নামে মানুষের। ভিড় উপচে পড়ে দশমীর দিনেও। বিকেলে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় মেলা প্রাঙ্গণে। গভীর রাতে প্রতিমা বিসর্জন। ততক্ষণ জমজমাট এলাকা। রবিবার সকালে পুজো দিতে হাজির রাখি সূত্রধর, জবা সূত্রধর, জ্যোৎস্না বাদ্যকর বা গায়েত্রী গড়াইদের গলায়ও সেই সুর। তাঁদের কথায়, ‘‘জগদ্ধাত্রী পুজোয় এখানে না থাকলে বা না এলে মনে হয় কিছু বাদ চলে গেল।’’

এলাকাবাসী জানাচ্ছেন, গ্রামে দুর্গাপুজো হয়। কিন্তু, জগদ্ধাত্রী পুজোয় ধূম আলাদা। পারিবারিক পুজো হলেও গ্রামের সকলের পুজো বলেই মনে করেন। বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়ের আসা-যাওয়া। উৎসবের স্থায়িত্ব মাত্র দু’দিনের। উৎসবের আনন্দে শুধু গোটা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার নয়। বিলকান্দি-সহ আশেপাশের বহু গ্রামের মানুষ সামিল হন। ভৌগোলিক সীমানা মুছে যোগ দেন রাজনগরের মানুষও। বিসর্জনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন গ্রামের আদিবাসী পরিবারগুলি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন