ভগ্নস্তূপে পরিণত পানীয় জলের কল।
মহাভারত খ্যাত একচক্রা নগরীর ময়ূরাক্ষী নদী ধারে কোটাসুর, এখন গঞ্জ শহর। জনশ্রুতি, এখানের মদনেশ্বর মহাদেবকে পাণ্ডব জননী কুন্তী পুজো করতেন। এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে নানা প্রত্ন-নিদর্শন আর কাহিনির সূত্র। সে সব কাহিনিতে কোথাও জুড়েছে বক রাক্ষসের হাঁটুর মালাইচাকির ফসিল, কোথাও পাল আমলের বিষ্ণু, অনাদিলিঙ্গ শিবমন্দির, সুদৃশ্য তোরণ, শিবরাত্রির বর্ণময় জল ঢালার দৃশ্য। আছে শ্রীকান্ত উপন্যাসের তৃতীয় পর্বের কমললতার লীলাভুমি বাউলপুকুর, তারাশঙ্করের অমরকুণ্ডার মাঠ, সাধিকা ক্ষেপিমায়ের ফুল সমাধিক্ষেত্র, নাম না জানা অজস্র পাখি আর গাছের সমাবেশ। এ সব মিলেই কোটাসুর হতে পারে পর্যটকের প্রিয় ভ্রমণক্ষেত্র।
বাসিন্দাদের দাবি, একটি পূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হোক কোটাসুরকে। ৫ টি বিভিন্ন রুটে সারাদিনে, প্রায় তিনশো বাস কোটাসুরের উপর দিয়ে চলাচল করে। কিন্তু কোনও বাসস্ট্যান্ড নেই। রাস্তায় থেকেই জলকাদা মাড়িয়ে বাসে ওঠানামা করতে হয় যাত্রীদের। ব্লক কার্যালয় থেকে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়-সহ নানা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। অথচ ডাক পরিষেবার হাল অত্যন্ত খারাপ। ডাককর্মীদের মর্জিমাফিক চিঠিপত্র বিলি হয়। একটি উন্নত মানের শাখা ডাকঘরের পাশাপাশি প্রয়োজন একটি উন্নতমানের গ্রন্থাগারেরও। কারণ বর্তমান জন-গ্রন্থাগারটি অধিকাংশ সময় বন্ধই থাকে। একদিকে সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে রাস্তা জুড়ে, অন্যদিকে বালির পাহাড় ভর্তি ওভারলোড ট্রাক চলে। এতেই রাস্তা বেহাল!
আদিত্য মুখোপাধ্যায়, লোকসংস্কৃতি গবেষক
এত নোংরা কেন চারপাশে
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রচারের ঢক্কা নিনাদে নিত্য খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ময়ূরেশ্বর ২ নং ব্লকের সদর দফতর হিসাবে খ্যাত কোটাসুরেই রয়েছে সমষ্টি উন্নয়নের করণ-সহ একাধিক সরকারি অফিস। সংশ্লিষ্ট কুণ্ডলা পঞ্চায়েত অফিসটিও কোটাসুরে। অথচ, কোটাসুরের বহু জনবহুল জায়গা নোংরা এবং আর্বজনায় রোগ ছড়ানোর আঁতুড় ঘর! দেখার কেউ নেই। প্রথমেই চোখে পড়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়টির হতশ্রী চেহারা। দিনের একটা বড় সময় কচিকাঁচাদের কাটে এই শিক্ষাঙ্গনে। কিন্তু সীমানা প্রাচীরের অভাবে গ্রামবাসীদের যথেচ্ছ ব্যবহারের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুল চত্বরটি। নোংরা আবর্জনার মধ্যে বাচ্চাদের মনে কুপ্রভাব পড়ছে। একই অবস্থা হাইস্কুল লাগোয়া পল্লিমঙ্গল ক্লাবের মালিকানাধীন খেলার মাঠটিরও। অযত্নে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে মাঠটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যাত্রী প্রতীক্ষালয়টির অবস্থাও তথৈবচ। নিয়মিত পরিস্কারের অভাবে অধিকাংশ সময় সেখানে ক্ষণমুহুর্তও টেকা যায় না। সভাসমিতি–উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার্য তিনকড়ি মেমোরিয়াল হলের অবস্থাও একই রকম। নাকে রুমালচাপা দিয়ে বসে থাকতে হয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত এবং আমন্ত্রণ কর্তাদের। এ বার প্রশাসন নজর দিক পরিচ্ছন্নতার দিকে। কোটাসুরের শ্যামচাঁদের মেলা জেলার অন্যতম আকর্ষণ। টানা কয়েকদিন মেলায় বাউল, ব্রতচারী-সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জমে থাকত মেলা। রাজনৈতিক আক্রোশে সেই মেলাটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। স্থানীয় বাসিন্দা এবং প্রশাসকরা মেলাটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিলে নতুন প্রজন্মের কাছে খুলে যাবে সংস্কৃতি চর্চা এবং বিনোদনের নতুন সকাল।
সুশীলকৃষ্ণ সেনগুপ্ত, সাহিত্যকর্মী
জল চাই, জল
গ্রাম থেকে গঞ্জ ছাড়িয়ে শহরের পথে পা বাড়িয়েছে কোটাসুর। প্রায় ২০ মানুষের বাস ইতিহাস আশ্রিত বর্তমান জনপদটিতে। তার উপরে ব্যবসা এবং কর্মসূত্রে প্রতিনিয়ত নিকটবর্তী গ্রাম কিংবা শহর থেকে ভিড় জমাচ্ছেন বহু মানুষ। কিন্তু তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত পানীয় জলের বড়ই অভাব। এক বড় সংখ্যক মানুষকে টিউবওয়েলের উপরের স্তরের দূষিত জলই খেতে হয়। কারণ একসময় পিএইচই ময়ূরেশ্বরের পাম্পিং স্টেশন থেকে কোটাসুরের একাংশে জল সরবরাহ শুরু করলেও বছর চারেক ধরে তা পুরোপুরি বন্ধ। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাসস্ট্যান্ড এলাকার রিজার্ভারে জল সরবরাহও। এর ফলে চরম সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ ওই রিজার্ভারটি থেকেই পানীয় জল সংগ্রহ করতেন যাত্রী এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। অথচ ২০০৯ বাড়ি বাড়ি সংযোগের জন্য পিএইচই স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতিকে দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। সেদিনও মাথা ঘামায়নি প্রশাসন। আজও জল সরবরাহ চালু করার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেই।
দুধকুমার মণ্ডল, রাজনৈতিক কর্মী
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল ফিরুক
দীর্ঘ টানাপড়েনের পর বেশ কয়েক বছর আগে কোটাসুরে একটি সহায়ক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে। বর্তমানে সেটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনও উন্নতি ঘটেনি। বরং তলানিতে ঠেকেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেশি কিছু মানুষ আশা করেন না। কিন্তু যে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু পাওয়ার কথা তাও বেশিরভাগ সময় মেলে না। সামান্য চিকিৎসার জন্যও এলাকার মানুষকে ছুটতে হয় দূরের সাঁইথিয়া কিংবা সিউড়ি হাসপাতালে। যাদের ওইসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি নেই তারা ভিড় জমান হাতুড়ের চেম্বারে। এমনকী স্থানীয় ওষুধের দোকানের কর্মীর কাছে রোগের উপসর্গ জানিয়ে ওষুধ কিনেও খান অনেকে। কিন্তু কিছুতেই যেন টনক নড়ে না স্বাস্থ্য দফতরের। অথচ বিরাট বিল্ডিং-সহ রয়েছে ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু তাদের সদিচ্ছা, প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র কার্যত এলাকার বাসিন্দাদের কোনও উপকারেই লাগছে না। অথচ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরেই এলাকার ২০-২৫টি গ্রামই শুধু নয়, সংলগ্ন ময়ূরেশ্বর ১ ব্লকেরও বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের মানুষ নির্ভরশীল। এঁদের অধিকাংশই মাঠে ঘাটে কাজ করা দারিদ্রের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী।
সত্যিটা হল, পরিষেবার বদলে তাঁদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া ‘রেফারের’ চিরকুট। সেই চিরকুট নিয়ে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথে অনেকেই প্রিয়জনকে হারান! হাল ফেরানোর জন্য বাসিন্দারা বহুবার প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তাই স্বাস্থ্যদফতরের ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ শ্লোগানটি নিছকই প্রচার সর্বস্ব মনে হয়।
সঞ্চিতা পাল, বাসিন্দা