সর্বজনীন: খয়রাশোলের নামোকেনান গ্রামে চলছে লক্ষ্মী প্রতিমা তৈরির কাজ। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রামে দুর্গা বা কালীপুজোর মতো কোনও বড় পুজো নেই। এক সময় এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল খয়রাশোলের নামোকেনান গ্রামের বাসিন্দাদের। তা টের পেয়ে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের তৎকালীন শিক্ষক দুঃখহরণ চট্টোপাধ্যায় ঘোষ পরিবারের কয়েক জন যুবককে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘কৃষি প্রধান গ্রাম আপনাদের। লক্ষ্মীপুজো করুন না!’
সে কথা মনে ধরেছিল যুবকদের। তবে, শুধু পরামর্শ দেওয়া নয়। গ্রামের কেউ জমি দিলে তা রেজিষ্ট্রি করানোর খরচও দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তিনি। গ্রামের কয়েক ঘর ঘোষ পরিবার জমি দান করেছিল। মাটি, বাঁশ, তালপাতা দিয়ে তৈরি হয় লক্ষ্মীমন্দির। পাশের গ্রামের দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের বিনিময়ে লক্ষ্মী প্রতিমা গড়ে দেওয়ার খরচ দিয়েছিল সেই গ্রাম। সেই শুরু। তিন দশক পেরিয়ে ঘোষ পরিবারের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোই এখন সর্বজনীন। নামোকেনান গ্রামের সেরা উৎসবও। পাকা লক্ষ্মী মন্দির হয়েছে। কলেবরে দিন দিন বাড়ছে উৎসব।
মঙ্গলবার গ্রামের লক্ষ্মী মন্দিরের সামনে উপস্থিত গণেশ ঘোষ, অরুণ ঘোষ, উত্তম ঘোষ, শিশির পালদের কাছে শোনা গেল, কেন লক্ষ্মীপুজো গ্রামের সেরা উৎসব হয়ে উঠল সেই কাহিনী। মন্দিরের ভিতরে তখন প্রতিমা গড়ার শেষ পর্যায়ের কাজ সারছেন শিল্পী সুভাষ সূত্রধর। তাঁকে ঘিরে রয়েছে এক দল কচিকাঁচা।
গ্রামের ইতিহাস বলছে, একদা জনপদহীন জঙ্গলঘেরা এলাকা ছিল নামোকেনান গ্রাম। হেতমপুর রাজাদের আমলে খাজনা আদায় করে ওই পথ গিয়ে ফেরার পথে দুষ্কৃতীদের কবলে পড়তে হয়েছে রাজার লোককে। কোনও লাঠিয়াল ওই এলাকায় বসবাস করলে ইচ্ছে মতো জমি চাষ করতে পারবে, রাজাদের এই শর্তে রাজি হয়ে খয়রাশোলের অজয় নদের
ধার ঘেঁষা চূড়র থেকে ওখানে প্রথম আসেন বিহারি পাল নামক এক প্রৌঢ়। পরে তিনি সংসারী হন। রীতিমতো বাড়তে থাকে পরিবার। পালেদের কোনও মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গ্রামের বাসিন্দা হন ঘোষরা।
এখন অবশ্য পাল্লা ভারি ঘোষদের। এ ভাবেই আত্মীয়তার সূত্রে গ্রামে কয়েক ঘর মণ্ডল, বারুই পরিবার এসেছে। গ্রামে গোটা ৬০ পরিবারের বাস। মূলত কৃষিজীবী গ্রামের জন্য লক্ষ্মীই আদর্শ। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, লক্ষ্মীপুজো শুরুর পর থেকে নামোকেনান ক্রমশ উন্নতির পথে এগোচ্ছে।
অরুণবাবু, উত্তমবাবুরা বলছেন, ‘‘সকলে সাধ্য মতো চাঁদা দেন। গ্রামে সকলে নিজেদের পুজো বলেই মনে করে। তাই ধুমধাম ভালই হয়।’’ পুজো উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে ধরে নানা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। অন্য বার যাত্রাও হয়। বসবে লোকগানের আসর। গ্রামের বধূ সন্ধ্যা পাল, সরমা ঘোষ বা দ্বাদশ শ্রেণির স্নিগ্ধা ঘোষেরা বলছে, ‘‘দারুণ আনন্দ হয় এই সময়টায়। কয়েকটা দিন হৈ হৈ করে কাটে। বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি আনন্দ করে। নতুন জামাকাপড় ভাঙা হয় লক্ষীপুজোতেই।’’ সবচেয়ে আকর্ষণের বিষয় হল বিসর্জনের সময় চকলেট-বৃষ্টি। বিজয়া উপলক্ষে সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।
এখনই অবশ্য বিসর্জন নিয়ে ভাবতে রাজি নয় খুদে শ্রাবণী ঘোষ, রিনা পাল, সুরজিৎ পাল, জয়া ঘোষেরা। ঠাকুর গড়া দেখার ফাঁকে তারা জানাচ্ছে, ‘‘আগে পুজোর কটা দিন পড়াশোনো বাদ দিয়ে আনন্দ তো করি। নতুন জামা কাপড় পড়ি। পরে না হয় চকলেটের কথা ভাবব।’’