টহল: বিষ্ণুপুর শহরের কাটানধারে বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
লোকসভা ভোটের বৈতরণী পার করতে এ বার সব দল ‘পাখির চোখ’ করেছে দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলকে। যার মধ্যে অন্যতম হল রানিবাঁধ বিধানসভা। এলাকার প্রবীণেরা জানাচ্ছেন, অনেক ভোট হয়েছে। আগে লোকসভা ভোট কখন আসত আর কখন চলে যেত তা টের পাওয়া যেত না। তবে এ বার সম্পূর্ণ আলাদা চিত্র। মাস দেড়েকের বেশি সময় ধরে প্রার্থীরা জঙ্গলমহলের গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে তৃণমূল ও বিজেপি প্রার্থী প্রচারের বেশির ভাগ সময়টাই দক্ষিণ বাঁকুড়ায় কাটাচ্ছেন।
কেন এত গুরুত্ব?
জেলা রাজনীতির ওঠাপড়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষকদের মতে, পাঁচ বছর আগে লোকসভা ভোটের সময় দক্ষিণ বাঁকুড়ায় প্রচারে জোর দিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকার। তিনি জিততে না পারলেও রানিবাঁধ বিধানসভা কেন্দ্র ভালই ভোট পেয়েছিলেন। যদিও দু’বছর পরে বিধানসভা ভোটে ওই কেন্দ্রেই বিজেপির ভোট কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে নজরে আসে জেলার জঙ্গলমহলের কিছু কিছু এলাকায় বিজেপির প্রভাব বেড়েছে।
কারন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজেপির বাঁকুড়া জেলা সাংগঠনিক সভাপতি বিবেকানন্দ পাত্র অভিযোগ করে, “উন্নয়নের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে জঙ্গলমহলে শুধু নাচ-গান হয়েছে। আদতে আদিবাসীদের কোনও উন্নয়ন করেনি তৃণমূল। তাই পঞ্চায়েত ভোট থেকেই জঙ্গলমহলের মানুষের মন আমাদের দিকে ঘুরতে শুরু করেছে।’’ তাঁদের আরও দাবি, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধী দলগুলিকে মনোনয়ন দিতে বাধা দেওয়া, মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার পথে বিজেপি কর্মী অজিত মুর্মুকে রাস্তায় খুন করার ঘটনা জঙ্গলমহলের মানুষ মেনে নিতে পারেননি। পঞ্চায়েতে ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়ার ঘটনার বদলা নেবে এ বার জঙ্গলমহল।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে রানিবাঁধ বিধানসভা এলাকায় একক ভাবে কোনও পঞ্চায়েত জিততে না পারলেও বিরোধী হিসেবে বিজেপিকে ছাপ ফেলতে দেখা গিয়েছে। এই বিধানসভার মধ্যে রয়েছে রানিবাঁধ, খাতড়া ও হিড়বাঁধ ব্লক। রানিবাঁধ ব্লকের ৮টি পঞ্চায়েতের প্রতিটিতেই খাতা খুলেছে বিজেপি। তার মধ্যে বারিকুলের ১১টি আসনের মধ্যে ৫টিতে জেতে গেরুয়া শিবির। অম্বিকানগরে ১০টির মধ্যে ৩টি ও হলুদকানালিতে ১১টির মধ্যে ৩টি আসনে জিতেছে বিজেপি। রুদড়ায় ১০টির মধ্যে ৪টি জিতেছে বিজেপি।
খাতড়া ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৫টিতেই বিজেপি এক বা একাধিক আসন পেয়েছে। হিড়বাঁধেও ৫টির মধ্যেও ৩টিতে খাতা খুলেছে বিজেপি। তার মধ্যে মলিয়ান পঞ্চায়েতে ১৪টি আসনের মধ্যে ৫টি পেয়েছে জিতেছে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভরাডুবি হলেও এই এলাকায় লোকসভা ভোটে ভাল ফলের ব্যাপারে আশাবাদী বাম শিবিরও। গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে তৃণমূলের পর দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএমই। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় এই এলাকায় বামকর্মীদের একটা বড় অংশ বিজেপিমুখী হয়েছিলেন। যদিও বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী অমিয় পাত্র দাবি করছেন, “রানিবাঁধ তো বটেই, পুরো জঙ্গলমহলে এ বার আমরা যথেষ্ট ভাল ফল করব।”
অন্যদিকে বিরোধীদের রুখতে জঙ্গলমহলে রাজ্য সরকারের উন্নয়নকেই হাতিয়ার করছে তৃণমূল। রানিবাঁধের বিধায়ক জ্যোৎস্না মান্ডি দাবি করেন, “এই এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। খাতড়া, রানিবাঁধ ও হিড়বাঁধ এই তিনটি ব্লক এলাকায় ৬টি বৈতরণি (শশ্মান) করেছি আমরা। ঝিলিমিলির রাউতোড়াতে হয়েছে নতুন কলেজ। পথবাতি, রাস্তাঘাট, স্টেডিয়াম, পুকুর সংস্কার-সহ উন্নয়ন হয়েছে সব ক্ষেত্রেই।”
যদিও রাস্তাঘাট নিয়ে কিছু এলাকায় মানুষের ক্ষোভ শোনা যাচ্ছে। রানিবাঁধ এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, অম্বিকানগর পঞ্চায়েতের হুচুক মোড় থেকে ধনঞ্জয়পুর, দামোদরপুর, ডাবরি, শিলডুংরি মহেশপুর হয়ে ভিরিঙ্গি মোড় পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার রাস্তা দীর্ঘদিন ধরে বেহাল হয়ে রয়েছে। ক্ষোভ রয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়েও। রানিবাঁধের খেজুরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হলুদকানালি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ঠিক মতো পরিষেবা পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ তুলছেন স্থানীয় মানুষজন। খাতড়া কেন এতদিনেও পুরসভা হল না, এই ক্ষোভও রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সরকারি শিবিরে ধান বিক্রি করতে না পারার অভিযোগও।
খাতড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা জঙ্গলমহল এলাকার তৃণমূলের পর্যবেক্ষক জয়ন্ত মিত্র দাবি করেন, “৩৪ বছরে বামফ্রন্ট জঙ্গমহলকে দুয়োরানি করে রেখেছিল। উন্নয়নের কাজ তৃণমূলের হাত ধরেই শুরু হয়েছে। প্রচুর কাজ হয়েছে। বাকি কাজও ধাপে ধাপে করা হবে।’’