আজ পুরুলিয়ার জন্মদিন, আনন্দের সঙ্গী আক্ষেপও

আজ, মঙ্গলবার পুরুলিয়ার জন্মদিন। দেখতে দেখতে ৬১ তম বছরে পা দিল সাবেক মানভূম। শুন বিহারী ভাই, তোরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাই... স্বাধীনতা উত্তরকালে সাবেক মানভূমের থিম সঙ ছিল এটাই। গানটি লিখেছিলেন পুরুলিয়ার তৎকালীন সাংসদ তথা গায়ক-কবি ভজহরি মাহাতো।

Advertisement

প্রশান্ত পাল ও সমীর দত্ত

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৩১
Share:

পুরুলিয়া শহরের শিল্পাশ্রমে চলছে উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

আজ, মঙ্গলবার পুরুলিয়ার জন্মদিন। দেখতে দেখতে ৬১ তম বছরে পা দিল সাবেক মানভূম।

Advertisement

শুন বিহারী ভাই, তোরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাই... স্বাধীনতা উত্তরকালে সাবেক মানভূমের থিম সঙ ছিল এটাই। গানটি লিখেছিলেন পুরুলিয়ার তৎকালীন সাংসদ তথা গায়ক-কবি ভজহরি মাহাতো।

স্বাধীনতার পরে এই ভূখণ্ডের মানুষই মাতৃভাষায় কথা বলার, প্রদেশ গঠনের দাবিতে নতুন লড়াই শুরু করেছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬, এই সময়ে আরও একটি নতুন ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে স্বাধীন ভারতবর্ষ। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯১২ সালে। সেই অর্থে একশো বছরেরও বেশি পুরনো। অথচ, সে তথ্য ভুলতে বসেছেন অনেকেই। সে কথা মনে করিয়ে দিতে নেই কোনও সরকারি উদ্যোগ। উপেক্ষার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে শহরের এক কোণে আধো অন্ধকারে কোনও রকমে নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রেখেছে ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত শিল্পাশ্রমও।

Advertisement

১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মানভূম জেলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পুরুলিয়া নাম নিয়ে বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতিহাস বলছে, ১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে সুবে বাংলাকে দু’ভাগে ভাগ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। একটি বাংলাদেশ, যার রাজধানী ছিল কলকাতা। অন্যটি বিহার-ওড়িশা প্রদেশ। তার রাজধানী ছিল পটনা। গোটা মানভূমকে বিহার-ওড়িশা প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বাংলা ভাষাভাষী এলাকাকে কেন বিহার-ওড়িশার অন্তর্ভূক্ত করা হবে, সে নিয়ে প্রতিবাদের ঝ়ড় ওঠে।

পুরুলিয়ার ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর মতে, ‘‘প্রতিবাদের স্বর উঠলেও সে সময় স্বাধীনতা আন্দোলনই ছিল মুখ্য। তাই এই আন্দোলন ততটা প্রচার পায়নি। তবে তলে তলে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হচ্ছিল।’’ সাতচল্লিশে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শুরু হল মানভূমের দ্বিতীয় আন্দোলন। যে সংগঠন মানভূমের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই লোকসেবক সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো জানাচ্ছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই অখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি করাচি অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন করা হবে। স্বাধীনতার পরে সেই বিষয়টিকে সামনে রেখে শুরু হয় দ্বিতীয় আন্দোলন। এই অঞ্চল বাংলা ভাষাভাষী হলেও বিহারের হিন্দির আগ্রাসনের শিকার হচ্ছিলেন এই এলাকার মানুষজন। তাই ক্রমেই প্রতিবাদ দানা বাঁধতে শুরু করে। সুশীলবাবুর কথায়, ‘‘১৯৫৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীপট্টি রামালু একই ভাবে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের দাবিতে টানা ৫২ দিন অনশনে মারা যান। রামালুর মৃত্যুর পরে মানভূমের আন্দোলন আরও গতি পায়।’’

ইতিহাস গবেষক দিলীপবাবুর ধরিয়ে দিচ্ছেন, রামালুর মৃত্যুর পরেই কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। জানানো হয় যে, ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন হবে। এই ঘোষণার পরে কমিশন পুরুলিয়ায় এসে বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য নেয়। সেই পর্বে লোকসেবক সঙ্ঘ ১৪ ট্যাঙ্ক নথি কমিশনের সদস্যদের কাছে উপস্থিত করেছিলেন। সেই নথির মধ্যে বাংলায় লেখা চিঠিপত্র, পুঁথি, জমির দলিল এমনকি পঞ্জিকাও ছিল।

বিপুল নথি দেখে কমিশনের প্রতিনিধিগন নিশ্চিত হন যে, এই এলাকার মানুষজন বাংলা ভাষাই ব্যবহার করেন। কমিশনের প্রতিনিধিগন বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষ্যগ্রহণের পরে ঠিক করেন সাবেক মানভূমের ৩১টি থানার মধ্যে ১৯টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া গঠন করা হবে। এই ১৯টি থানাই ছিল বাংলা ভাষাভাষী এলাকা। পরে অবশ্য ১৪টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠিত হয়। অন্য দিকে, অন্ধ্রপ্রদেশ যখন নতুন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল তখন সেই রাজ্যে উৎসব পালিত হয়। তাতে মানভূম থেকে ভাষা আন্দোলনের অনেক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত-সহ অনেকেই সেখানে গিয়েছিলেন।

তত দিনে মানভূমকে বাংলায় অন্তর্ভূক্ত করার দাবিতে আন্দোলন দুর্বার হয়েছে গোটা মানভূমেই। পুরুলিয়া থেকে কলকাতা পদযাত্রা, বিভিন্ন জায়গায় আইন অমান্য-সহ নানা আন্দোলনে উত্তাল হয় মানভূম। ক্রমশ মেলে দ্বিতীয় স্বাধীনতা।

‘‘সে কথা আর কারই বা মনে রয়েছে’’— আক্ষেপ করছিলেন জেলার আর এক ইতিহাস গবেষক সুভাষ রায়। তাঁর মতে, ‘‘চার দিকে এত অনুষ্ঠান হচ্ছে, অথচ পুরুলিয়ার এই গৌরবময় ইতিহাস চর্চার উদ্যোগ কোথায়?’’ এটা অত্যন্ত যন্ত্রণার, মনে করেন লোকসেবক সঙ্ঘের সচিব সুশীল মাহাতো। তিনি মনে করেন, ‘‘এই উপেক্ষা বা অবহেলা আগেও দেখেছে মানভূমের মানুষ। এখনও দেখছেন। বলতে পারেন ইচ্ছাকৃত ভাবেই ভুলে থাকা হচ্ছে।’’

সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অবশ্য এই আন্দোলনের ইতিহাস অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। রেজিষ্ট্রার নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুরুলিয়ার জন্মদিবস স্মরণে রাখতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে। তবুও বলব এই গৌরবময় ইতিহাসের যতটা জনপ্রিয়তা পাওয়ার দরকার ছিল ততটা হয়নি।’’

চর্চার অভাবে যা হওয়ার হয়েছেও তাই। এই প্রজন্মের প্রতিনিধি পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা সোমনাথ সেন যেমন খোলাখুলিই মানছেন, ‘‘সত্যি বলতে কি, আমি জানিই না পুরুলিয়ার জন্মদিনের কোনও ইতিহাস রয়েছে।’’

তা হলে?

মানভূম কলেজের অধ্যাপক প্রদীপ মণ্ডল বা বান্দোয়ানের ঋষি নিবারণচন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক অমিয় চক্রবর্তীর প্রস্তাব, ‘‘বিষয়টিকে স্কুলপাঠ্য করা প্রয়োজন। তবেই তো নতুন প্রজন্ম মানভূমের এই গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন