তৃণমূল কর্মী খুনের জের

থানায় ডাক, গ্রেফতার মনোরঞ্জন

সেই ঘটনাতেই পুলিশ শুক্রবার সিপিএমের চার বারের প্রাক্তন বিধায়ককে গ্রেফতার করায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে পুলিশ দিয়ে বিরোধীদের জব্দ করার খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তালড্যাংরা শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭ ০১:০৩
Share:

খাতড়া আদালতে। নিজস্ব চিত্র

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই তৃণমূল কর্মী খুন হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। যা নিয়ে দলের অন্দরে কম চাপানউতোর হয়নি। সেই ঘটনাতেই পুলিশ শুক্রবার সিপিএমের চার বারের প্রাক্তন বিধায়ককে গ্রেফতার করায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে পুলিশ দিয়ে বিরোধীদের জব্দ করার খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা।

Advertisement

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বিবৃতিতে জানিয়েছেন, মনোরঞ্জনবাবুকে সাজানো মামলায় গ্রেফতার করার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। ধিক্কার জানাতে রাজ্যের সর্বত্র প্রতিবাদ, বিক্ষোভের কর্মসূচি সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। প্রতিবাদে এ দিনই বিকেলে বাঁকুড়া শহরের মাচানতলায় মিছিল করে পথসভা করে সিপিএম।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে ঘর ছেড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা তালড্যাংরার ঢ্যামনামারা গ্রামের তৃণমূল কর্মী জান মহম্মদ মল্লিককে (২৮) গত ১৩ সেপ্টেম্বর পিটিয়ে খুন করা হয়। বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যাম মুখোপাধ্যায়ের অনুগামী ছিলেন জান মহম্মদ। খুনের পরে নিহতের পরিবার ও শ্যামবাবুর অনুগামীরা একযোগে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকেই খুনের জন্য দায়ী করেছিলেন। যদিও পুলিশের দাবি, আমড্যাংরার বাসিন্দা তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মনোরঞ্জন পাত্রের নির্দেশেই ওই খুন হয়েছিল।

Advertisement

শুক্রবার রাতে মনোরঞ্জনবাবুকে তালড্যাংরা থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা শনিবার দাবি করেন, “তদন্তে নেমে এই ঘটনায় মনোরঞ্জনবাবুর জড়িত থাকার তথ্য আমরা পেয়েছি। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” তদন্তকারীদের দাবি, জান মহম্মদকে খুনের ঘটনায় মনোরঞ্জনবাবু-সহ এখনও পর্যন্ত ১১ জন ধরা পড়েছে।

বৃহস্পতিবার জান মহম্মদ খুনে মূল অভিযুক্ত ঢ্যমনামারা এলাকার বাসিন্দা ইয়াকুট আলি খান ওরফে ভাদু গ্রেফতার হয়। ওড়িশায় গা ঢাকা দিয়েছিল সে। ফিরতেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে হেফাজতে নেয়। পুলিশের দাবি, ভাদু জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছে দাবি করেছে, মনোরঞ্জনবাবুই তাকে এলাকায় ‘দু-একটা’ খুন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপরেই পরিকল্পনা করে জান মহম্মদকে খুন করা হয় বলে দাবি পুলিশের।

তালড্যাংরা ব্লক তৃণমূলের সহ-সভাপতি তথা আমড্যাংরা, সাতমৌলি ও শালতোড়া অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি নিতাই চক্রবর্তী এ দিন দাবি করেছেন, “ভাদুকে লোকে বরাবরই সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতী বলে জানে। জান মহম্মদকে খুনের পিছনে মনোরঞ্জন পাত্র থাকতে পারে বলে প্রথম থেকেই আমরা অনুমান করেছিলাম।”

২০১০ সালের ২৯ জুন তালড্যাংরা থানার রাজপুরে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন তৃণমূল কর্মী মদন খাঁ। তৎকালীন বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্র-সহ ২২ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু বাম আমলে পুলিশ তাঁকে ছুঁতে পারেনি। শেষে ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি খাতড়া আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। কয়েক মাস জেল খেটে জামিনে ছাড়া পান। পাঁচ বছর পরে ফের তৃণমূল কর্মী খুনে জেলে গেলেন তিনি। এ দিন খাতড়া আদালতে তোলা হলে মনোরঞ্জনবাবুকে ১১ দিনের জেল হাজতে পাঠানো হয়। পুলিশ সুপারের দাবি, ‘‘শুক্রবার রাতেই ভাদু ও মনোরঞ্জনবাবুকে মুখোমুখি বসিয়ে যা তথ্য সংগ্রহ করার হয়ে গিয়েছে। তাই আর পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।’’

জোট প্রার্থী হিসেবে গত বিধানসভা ভোটে বিষ্ণুপুরের তৃণমূল প্রার্থী শ্যাম মুখোপাধ্যায়কে হারান তুষারবাবু। সে সময় তুষারবাবুর জয়ে বড় ভূমিকা ছিল মনোরঞ্জনবাবুর। আমড্যাংরার সিপিএম কর্মীরাও তুষারবাবুকে জেতাতে প্রাণপাত করেন। ভাদুও সে ভাবেই তুষারবাবুর অনুগামী হয়ে উঠেছিলেন বলে এলাকাবাসীর একাংশের দাবি। যদিও নিতাইবাবুর দাবি, “ভাদু কোনও দিনই তৃণমূলের কর্মী ছিল না।” তুষারবাবু বলেন, “আমার হয়ে প্রচারে ওই এলাকার বহু মানুষ বেরিয়ে ছিলেন। পরে তাঁরা আমার সঙ্গেই তৃণমূল করেন। তবে সব কর্মীকে আমার পক্ষে আলাদা করে চেনা সম্ভব নয়।” মনোরঞ্জনবাবুর গ্রেফতারি নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

তালড্যাংরার বাসিন্দা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র দাবি করেন, “পুলিশ দলদাসের ভূমিকা পালন করছে। মনোরঞ্জনকে ফাঁসিয়ে তৃণমূল এক দিকে নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঢাকা দিতে চাইছে, অন্য দিকে পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিরোধীদের কড়া বার্তা দিতে চাইছে।’’ আজ, রবিবার থেকে ১১৭টি বামপন্থী গণসংগঠনের যৌথ মঞ্চ বিপিএমও মানুষের নানা সমস্যা নিয়ে রাজ্যে জাঠা কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক শ্যামল চক্রবর্তী বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, যৌথ জাঠা কর্মসূচির গতিপথ আটকানোর জন্যই মঞ্চের সংগঠক ও কৃষক আন্দোলনের নেতা মনোরঞ্জনবাবুকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করেছে সরকার।

বামেদের অভিযোগ, রাজ্যজুড়েই বিরোধীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে তৃণমূল। সম্প্রতি তমলুকে জেলাশাসকের কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি-সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে সতেরো বছরের পুরনো একটি খুনের মামলায় নিরঞ্জনবাবুকে হেফাজতে নেয় সিআইডি। বর্তমানে তিনি জেলে রয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন