আড়শা-কাণ্ডে প্রতিবাদ

দু’দিন পরে খুনিরা কেন অধরা, প্রশ্ন

সোমবার কেন্দুয়াডি গ্রামের নিহত যুবক ধরণী সিং সর্দারের বাবা সীতারাম সিং সর্দার আড়শা থানায় অভিযোগ দায়ের করে জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে স্ত্রী ও বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়েই গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। চার জন হামলা করলেও তাঁরা অজ্ঞাতপরিচয় বলে দাবি তাঁর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

আড়শা শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৭:৫০
Share:

ঘটনাস্থলে তদন্তে পুলিশ। নিজস্ব চিত্র

স্ত্রী ও বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে গণপিটুনিতে যুবকের মৃত্যুর ঘটনার পর দু’দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ দুষ্কৃতীদের নাগাল পেল না। আড়শায় একাদশীর রাতের ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। শাসক থেকে বিরোধী দলের নেতারা দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে সরব হয়েছেন। ঘটনার প্রতিবাদে এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সোমাবার সন্ধ্যায় পুরুলিয়া শহরের পথে নামে এসইউসি-র মহিলা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যেরা।

Advertisement

সোমবার কেন্দুয়াডি গ্রামের নিহত যুবক ধরণী সিং সর্দারের বাবা সীতারাম সিং সর্দার আড়শা থানায় অভিযোগ দায়ের করে জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে স্ত্রী ও বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়েই গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। চার জন হামলা করলেও তাঁরা অজ্ঞাতপরিচয় বলে দাবি তাঁর।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার রাত প্রায় ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে, আড়শা-বেগুনকোদর রাস্তায় জীবনডি জোড়ের কাছে। নিহতের স্ত্রী শিবানি সিং সর্দার এ দিন জানান, অজ্ঞাত পরিচয় জনা চারেক যুবক অভব্যতা শুরু করেছিল আড়শাতেই। যাত্রা মঞ্চের কাছাকাছি একটি দোকানে ধরণী খাবার কিনতে ঢুকেছিলেন। সেই সময় একটি ছেলে শিবানি ও তাঁর ননদ গঙ্গাকে লক্ষ করে আপত্তিকর মন্তব্য করে। প্রথমে তাঁরা আমল দেননি। কিন্তু, ধরণী প্রতিবাদ করেন।

Advertisement

শিবানি বলেন, ‘‘সেই ছেলেটার সঙ্গে আরও কয়েকটা ছেলে ফের আপত্তিকর কথা বলতে থাকায়, আমি তাদের বলি, ‘অসভ্যতা করলে পুলিশের কাছে যাব’। তখন ওদের এক জন বলে, পুলিশ কিছুই করতে পারবে না। কথা না বাড়িয়ে স্বামী আমাদের নিয়ে মোটরবাইকে উঠে বাড়ির পথে রওনা দেয়।’’

গোলমাল বাডে এর পরেই। শিবানীর অভিযোগ, ‘‘ছেলেগুলো দু’টি মোটরবাইকে আমাদের পিছু নেয়। একটা প্রায় জনবসতিহীন জায়গায় তারা আমাদের মোটরবাইক আটকায়। এক জন আমার শাড়ির আঁচল ধরে টানার চেষ্টা করলে আমি তার জামার কলার চেপে ধরি। আমার স্বামীও প্রতিবাদ করে। ছেলেগুলো আমার স্বামীকে ঘিরে ধরে। হঠাৎ কে যেন আমাকে মারে। রাস্তায় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাই।’’

ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী নিহতের বোন গঙ্গা রবিবার দাবি করেছিলেন, দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তার দাদার ধস্তাধস্তি হচ্ছিল। তারপরে তারা দূরে সরে যান। অন্ধকারে আর কিছু ঠাহর করতে সে পারেনি। পরে গ্রামের লোকেদের রাস্তায় পেয়ে সব জানাতে, তাঁরাই ধরণীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাস্তা থেকে কিছুদূরে উদ্ধার করেন।

নিহতের বাবার অভিযোগ, ‘‘ছেলেগুলো অসভ্যতা করছিল বলে ধরণী প্রতিবাদ করে। সে জন্য ছেলেগুলো ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। আমি পুলিশকে বলেছি, দোষীরা কেউ যেন ছাড়া না পায়। না হলে, এলাকায় মেয়েদের নিরাপত্তা বলে আর কিছু থাকবে না।’’ শিবানি বলেন, ‘‘দোষীদের কড়া সাজা দিলেই আমার স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে।’’

খবর পেয়ে রবিবার সকালে পুলিশ এলাকায় গিয়ে তদন্ত শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করেছে এলাকায়। কিন্তু, রবিবার পর্যন্ত পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পারেনি। তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জেলার বিভিন্ন মহলে।

প্রশ্ন ১: ঘটনাস্থলের দূরত্ব আড়শা থানা থেকে কমবেশি দুই থেকে সওয়া দু’কিলোমিটার। প্রশ্ন উঠেছে, একাদশীর রাতে যাত্রা দেখে আশপাশের গ্রামের মানুষ বাড়ি ফিরবেন জেনেও রাস্তায় কি পুলিশের টহল ছিল? প্রশ্ন ২: যদি টহল থাকে, তাহলে দুষ্কৃতীরা এতটা পথ ধাওয়া করে মহিলাদের উত্ত্যক্ত করে ও তারপরে খুন করে পালাল কী ভাবে? প্রশ্ন ৩: দুষ্কৃতীদের পরিচয় নিহতের পরিবার না জানাতে পারলেও, পুলিশ নিজের সোর্স লাগিয়ে দু’দিনেও কেন তা উদ্ধার করতে পারল না? প্রশ্ন ৪: ওই ছেলেগুলিকে যাত্রার কাছে যাঁরা শিবানীদের উত্ত্যক্ত করতে দেখেছিলেন, তাঁরাই বা কেন চুপ করে রয়েছেন? পুলিশের কাছে তাঁরা কেন মুখ খুলছেন না?

স্থানীয় বিধায়ক তথা জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতোর মন্তব্য, ‘‘স্ত্রী ও বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে উৎসবের রাতে একটা প্রতিবাদী যুবককে প্রাণ দিতে হল! এটা মানা যায় না। এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ কী করছিল? দ্রুত পুলিশকে তদন্ত করে দোষীদের গ্রেফতার করে যাতে কড়া সাজা পায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’’ পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্যদ মন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোও বলেন, ‘‘পুলিশকে নিরপেক্ষ তদন্ত করে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে হবে।’’

সোমবার সন্ধ্যায় পুরুলিয়া শহরে এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে এসইউসি-র মহিলা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যেরা। সংগঠনের জেলা সম্পাদক রানি মাহাতো বলেন, ‘‘মহিলাদের নিরাপত্তার যে কী অবস্থা, তা আড়শার ওই ঘটনা ফের সামনে এনে দিয়েছে। উৎসবের মধ্যে পথে পুলিশের নিরাপত্তা কেন থাকবে না? কার ভরসায় মেয়েরা রাস্তায় বেরোবে। আমরা দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি তুলেছি। আড়শাতেও আমাদের সংগঠনের সদস্যেরা পুলিশের কাছে গিয়ে এই দাবি তুলেছেন।’’

জেলা পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়া রাতে বলেন, ‘‘অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানও রেকর্ড করা হয়েছে। তবে রহস্যজনক ভাবে নিহতের মোটরবাইকটি ঘটনাস্থলে ছিল না। অন্যত্র পাওয়া গিয়েছে। তদন্ত চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন