খাঁড়াতেই পুজো হয় বাবুগ্রামে

এই পুজোয় কোনও মূর্তি নেই। পরিবর্তে খাঁড়াকেই প্রতীক করে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। অন্তত সাড়ে চারশো ধরে এই রীতি মেনে আসছেন রঘুনাথপুর থানার বাবুগ্রামের সিংহদেও পরিবার।

Advertisement

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৩৬
Share:

বাবুগ্রামে সিংহদেও পরিবারের দুর্গা মন্দিরে। —নিজস্ব চিত্র।

এই পুজোয় কোনও মূর্তি নেই। পরিবর্তে খাঁড়াকেই প্রতীক করে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। অন্তত সাড়ে চারশো ধরে এই রীতি মেনে আসছেন রঘুনাথপুর থানার বাবুগ্রামের সিংহদেও পরিবার। কেন খাঁড়র পুজো হয় তা জানা যায়নি। তবে খাঁড়া নিয়ে রয়েছে ইতিহাস।

Advertisement

সাবেক পঞ্চকোট রাজ্যের শিখর রাজবংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল বাবুগ্রামের সিংহদেও পরিবারের। এখনও সেই অতীত দিনের গরিমা এখানকার পুজোয় দেখা যায়। সপ্তমীতে সিংহদেও পরিবারের সদস্যেরা খোলা তরোয়াল হাতে নিয়ে কমলিয়া বাঁধ থেকে জল আনতে যান। পুজোর দু’দিনে মোষ বলির রেওয়াজও রয়েছে।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, মধ্যপ্রদেশের ধারা নগরের আদি বাসিন্দা এই সিংহদেও পরিবারের পদবি অবশ্য আগে ছিল শাহ। বংশের ৪৮তম পুরুষ ঠাকুররাম শাহর চতুর্থ উত্তরসূরি অধুনা ঝাড়খণ্ডের চুটিয়া নাগপুর তথা রাঁচীর বাসিন্দা অমর শাহকে সিংহদেও পদবি দিয়েছিলেন মোগল সম্রাটরা। সেই অমর শাহ তথা অমর সিংহদেও মোগল সম্রাটদের কাছ থেকে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের মহিন্দা মৌজা দেবোত্তর হিসাবে পান। জেলার ইতিহাস বলছে, ১৫৬৭ সালে মহিন্দা মৌজা তথা বাবুগ্রামে আসেন অমর সিংহদেও। তাঁর বড় ছেলে কিষান পাড়া থানার ঠাকুরডি মৌজা পেয়েছিলেন। ছোট ছেলে রতন সিংহদেও রাঁচীর কাছে এক যুদ্ধে প্রাণ হারান। রতনের ছেলে কাঞ্চল সিংহদেওর পাঁচ ছেলে। তাঁদের মধ্যে দু’জন ছিলেন নিঃসন্তান। বাকি তিন সন্তান ধনঞ্জয়,শত্রুঘ্ন ও বাহাদুরের বংশধরেরাই এখন বাস করেন বাবুগ্রামে।

Advertisement

অমর সিংহদেওর হাতেই বাবুগ্রামের পুজোর প্রবর্তন। পরিবার সূত্রেই জানা গিয়েছে, তিনি চুটিয়া নাগপুর থেকে আসার সময় সঙ্গে এনেছিলেন পারিবারের খাঁড়াটি। পরিবারের বর্তমান সদস্য সমর সিংহদেও বলেন, ‘‘খাঁড়ার কেন পুজো হয় তা পরিষ্কার নয়। তবে, মনে করা হয়, সম্ভবত চুটিয়া নাগপুরে দুর্গা প্রতিমার হাতে থাকা খাঁড়াটিকেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন অমর সিংহদেও। তাই প্রতিমার বদলে এই খাঁড়ার পুজো হয়।’’

বস্তুত, চুটিয়া নাগপুরের মতান্তরে (ছোট নাগপুর) এই নাগ বংশের সঙ্গে পঞ্চকোট রাজ্যের শিখর রাজবংশের আত্মীয়তা বহুদিনের। পঞ্চকোট রাজবংশের ইতিবৃত্ত নিয়ে গবেষণা করা পুরুলিয়ার বাসিন্দা লোক-গবেষক দিলীপ গোস্বামী জানান, রাখালচন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা ‘পঞ্চকোট রাজবংশের ইতিহাসে’ই উল্লেখ আছে অধুনা ঝাড়খণ্ডের রাঁচীর চুটিয়া নাগপুরের বাসিন্দা এই নাগবংশের সঙ্গে পঞ্চকোট রাজ্যের শিখর রাজবংশের বৈবাহিক সম্পর্কের কথা।

পঞ্চকোট রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দামোদর শেখরের বিয়ে হয়েছিল চুটিয়া নাগপুরের এই নাগ বংশে। পঞ্চকোট রাজবংশের অন্যতম রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহদেও-র মামাবাড়ি এই বাবুগ্রামে। অর্থাৎ জ্যোতিপ্রসাদের বাবা হরিনারায়ণ সিংহদেও বিয়ে করেছিলেন বাবুগ্রামের গোলাপিদেবীকে।

এই পুজোকে ঘিরে অতীত এখনও সামনে আসে। আগে তরোয়ালের সঙ্গে বন্দুক নিয়ে জল আনতে যাওয়া হত। এখন অবশ্য বাদ পড়েছে বন্দুক। সমরবাবু জানান, জিতাষ্টমীর পরের দিনই পুজো শুরু হয় সিংহদেও পরিবারের। পরের দিন নবমীতে হয় পুজোর বোধন। যর্জুবেদ অনুযায়ী হওয়া পুজো হয় শাক্তমতে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিন দিন বলি হয়। রাজঘরানার পুজোয় একদা ব্রাত্য ছিল সাধারণ মানুষ।

সময়ের সঙ্গে বদল ঘটেছে চিন্তার। পৌনে দুশো বছর আগে এই সিংহদেও পরিবারই গ্রামে আরও একটি দুর্গামন্দির তৈরি করে প্রতিমা এনে পুজো শুরু হয়। কিন্তু, খাঁড়া পুজোর ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন সিংহদেও পরিবারের সদস্যেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন