স্বামীর ছবি হাতে শকুন্তলাদেবী। —নিজস্ব চিত্র
মেঘলা দিনে এক দঙ্গল ছেলে ফুটবল পিটছিল। হঠাৎ গুলিরই শব্দ। একটা নয়, পরপর তিনটে। ভয়ে খেলা থামিয়ে দিয়েছিল ছেলেগুলো। হলটা কী? হতভম্ব ভাবটা কাটতেই ওরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল বড়রাস্তার দিকে। বাঁকের মুখে রাস্তার পাশে পড়েছিল একটা প্রৌঢ়। তাঁর শরীর বেয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা।
ঘটনাটি ২০১০ সালের ২৮ জুলাইয়ের। রাজ্যজুড়ে তখন পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা তখন দ্বিগুণ উদ্যোমে সংগঠন গোছাতে নেমে পড়েছিলেন। আর বামফ্রন্ট তথা সিপিএম নেতা-কর্মীরা ক্ষমতা ধরে রাখতে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময়েই মানবাজার-বান্দোয়ান রাস্তায় বুরুডি গ্রামের মোড়ে সন্ধ্যার মুখে খুন হয়ে যান এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা তথা মানবাজার ২ পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা হলধর মাহাতো। শরীরে বিঁধেছিল তিনটে গুলি— বুকে, পেটে এবং ঘাড়ের বাঁদিকে। প্রৌঢ় হলধরবাবুর বাড়ি দিঘি গ্রামে। তাঁর রেশন দোকানও ছিল। ফলে এলাকায় তাঁর ভালই পরিচিতি ছিল। খুনের খবর তাই ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।
হলধরবাবু সে দিন মানবাজার ২ পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে বৈঠক সেরে নিজের মোটরবাইকে বাড়ি ফিরছিলেন। মানবাজার থানা থেকে যখন তিনি আধ কিলোমিটার দূরে, সেই সময় তাঁকে খুন করা হয়। ঘটনাস্থল কয়েকশো মিটার দূরে কিছু ছেলে ফুটবল খেলছিল। তারাই প্রথম তাঁকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে দেহ তুলে নিয়ে যায়।
কিন্তু এলাকার জনপ্রিয় ওই নেতার মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি তৃণমূল কর্মীরা। খুনের পরেই অভিযোগের তির ওঠে এলাকার সিপিএম নেতাদের দিকেই। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে তৃণমূল কর্মীরা থানা ঘেরাও করে অনেক রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখান। শেষে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আততায়ীদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি পুলিশ কর্তারা দেওয়ার পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
নিহতের স্ত্রী শকুন্তলা মাহাতো তাঁর স্বামীর খুনের জন্য এলাকার বাসিন্দা তথা বান্দোয়ানের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সুধাংশু মাঝি, সিপিএমের জোনাল সদস্য বৈদ্যনাথ সোরেন, সিপিএম কর্মী সুকুমার পরামাণিক, জগদীশ মান্ডি ও বুদ্ধেশ্বর মুর্মুর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে এলাকায় রাজনীতির ক্ষমতা ধরে রাখা নিয়ে হলধরবাবুর সঙ্গে স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের রেষারেষি চলছিল। যার জেরে সিপিএম পরিচালিত পঞ্চায়েতের কাজকর্ম নিয়ে কখনও সখনও প্রতিবাদ করতে দেখা যেত তাঁকে। ফলে সিপিএম নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি।
প্রাথমিক ভাবে তদন্তের গতি-প্রকৃতি বুঝে পুলিশ ধরপাকড়ে নামে। একে একে ধরা হয় পাঁচ অভিযুক্তের মধ্যে চারজনকেই। শুধু বাইরে থেকে যায় প্রাক্তন বিধায়কের ছায়াসঙ্গী বুদ্ধেশ্বর মুর্মু।। অভিযোগ ছিল, তিনিই গুলি চালিয়ে খুন করেছেন। ঘটনার পর থেকেই তিনি গাঢাকা দিয়েছিলেন। তবে পুলিশের নজর এড়িয়ে বেশিদিন বাইরে থাকতে পারেননি। ঘটনার মাস তিনেক পরে কলকাতা হাইকোর্ট চত্বরে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাফেরা করায় সাদা পোশাকের পুলিশ বুদ্ধেশ্বরকে গ্রেফতার করে। তাঁর কোমর থেকে একটি দেশি পিস্তল মিলেছিল। জেলার এক পুলিশ কর্তার দাবি, বুদ্ধেশ্বরের কাছে পাওয়া পিস্তল দিয়েই হলধরকে খুন করা হয়েছিল বলে তাঁরা অনেকাংশে নিশ্চিত। আগে ধৃত চারজন খুনের কথা পুলিশের জেরায় স্বীকার না করায় পুলিশের তদন্ত তখন বিশেষ এগোয়নি। ভাবা হয়েছিল, বুদ্ধেশ্বর ধরা পড়লে বিশেষ অগ্রগতি হবে। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। সকলেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ফলে গ্রেফতারের ৯০ দিনের মধ্যে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দিতে পারেনি। একে একে পাঁচ অভিযুক্তই জামিনে এখন মুক্ত।
যদিও পুলিশের দাবি, তদন্তে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ওই পাঁচজনের ঘটনার দিনে গতিবিধি সন্দেহজনক ছিল। সে দিন ওই রাস্তা দিয়ে অভিযুক্তদের অনেককেই বেশ কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে। তাঁদের বক্তব্যও পুলিশের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। পুলিশ বেশ কয়েকমাস পরে চার্জশিট জমা দেয়। এখন শুনানি
পর্ব চলছে।
এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘মামলার প্রথমভাগে হলধরবাবুর পক্ষের সাক্ষীরা যে ভাবে শুনানিতে গিয়ে সহযোগিতা করছিলেন, শেষ দিকের শুনানিতে তাঁরা বেশির ভাগ দিনই গরহাজির থাকছেন। এতে মামলা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।’’ নিহত নেতার পরিবারেরও একই ক্ষোভ। হলধরবাবুর বড় ছেলে পরিতোষ মাহাতো বলেন, ‘‘জঙ্গলমহলের এই এলাকায় সিপিএমের শাসনকালে তৃণমূল করতে যথেষ্ট সাহস লাগত। সে সব অগ্রাহ্য করে বাবা দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করত। তাঁর জনসংযোগের জন্য সিপিএম নেতা-কর্মীরা বাবাকে ভয় পেত। এ কারণে তাঁকে সরিয়ে দেয় সিপিএম।’’ নিহতের স্ত্রী শকুন্তলাদেবী বলেন, ‘‘আমার স্বামী রাজনীতি করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। তৃণমূল সরকারে আসার পর ভেবেছিলাম আমার স্বামীর খুনীদের উপযুক্ত সাজা হবে। কিন্তু মামলার শুনানীর দিন যে ভাবে দীর্ঘতর হচ্ছে, কবে যে রায় বের হবে কে জানে!’’ তাঁর ক্ষোভ, স্বামীর সহকর্মী যে সব নেতা-কর্মী প্রথমদিকে সাক্ষ্যের শুনানির দিন নিয়মিত হাজিরা দিতেন, এখন আর তেমন ভাবে আদালতে হাজির হচ্ছেন না।
তৃণমূলের মানবাজার ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি হংসেশ্বর মাহাতোও বলেন, ‘‘হলধরবাবুর সাথে যাঁরা ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করতেন, তাঁদের কয়েকজন সাক্ষী হিসাবে রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেছি বেশ কয়েকটি শুনানিতে তাঁরা আদালতে হাজির হননি। জেলা নেতৃত্ব তা জানেন।’’ যদিও দলের ওই নেতা-কর্মীদের পাল্টা অভিযোগ, হলধরবাবুর পরিবারের লোকেরাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। তা ছাড়া দলে এখন নতুন লোকেদেরই দাপট। তাঁরা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছেন।