বাড়ি ছাড়া নিঃসঙ্গ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের অভিনয়ে ভিটেহারা ‘উপেন’-এর যন্ত্রণা

কেউ এসেছেন দমদম থেকে। কারও বাড়ি উত্তরপাড়ায়। তবে তাঁদের ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম। বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের বিকনায় ওই বৃদ্ধাশ্রম। অবারিত মাঠের পার হয়ে ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়। যেমন জায়গায় ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’-র উপেনের বসত।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৭ ১২:৪৫
Share:

মঞ্চে: রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন। নিজস্ব চিত্র

কেউ এসেছেন দমদম থেকে। কারও বাড়ি উত্তরপাড়ায়। তবে তাঁদের ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম। বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের বিকনায় ওই বৃদ্ধাশ্রম। অবারিত মাঠের পার হয়ে ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়। যেমন জায়গায় ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’-র উপেনের বসত। রবিবার, বাড়ি ছাড়া সেই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের অভিনয়ে ফুটে উঠল কবিতার ভিটেহারা উপেনের যন্ত্রণা। তারুণ্যের দমকা বাতাস বয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রমে।

Advertisement

বিকনার বৃদ্ধাশ্রমে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের বন্দোবস্ত করেছিল বাঁকুড়া থিয়েটার অ্যাকাডেমি। প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল শুক্রবার থেকেই। আবাসিকদের নিয়ে নাচ, গান, আবৃত্তি আর শ্রুতি নাটকের মহড়া করে গিয়েছেন অ্যাকাডেমির কলাকুশলীরা। তবে মূল আকর্ষণ ছিল ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা অবলম্বনে নাটক। ওই নাটকে অ্যাকাডেমির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমান তালে অভিনয় করেছেন বৃদ্ধাশ্রমের দুই আবাসিক।

প্রাক্তন রেল কর্মী, কলকাতার দমদমের বাসিন্দা, বছর চুয়াত্তরের নরেন্দ্রনাথ আচার্য স্ত্রী অপর্ণাদেবীর সঙ্গে বিকনার বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন বছর ছয়েক ধরে। তাঁর মধ্যে যে এমন একটা দাপুটে অভিনেতা ঘাপটি মেরে ছিল সেটা এত দিন টেরই পাননি। নাটকে জমিদারের পার্ট তাঁর। সাজগোজ চরিত্র যেন ভর করল তাঁর উপরে। ঠাট আনতে অ্যাকাডেমির ছেলেমেয়েরা হাতে একটা লাঠি দিয়েছিল। একটু নেড়েচেড়ে সটান বলে দিলেন, ‘‘এমন পুরনো ফাটা লাঠি নিয়ে জমিদার রাস্তায় বেরোবে নাকি। এটা বরং মালিকে দিয়ে দাও।’’

Advertisement

উত্তরপাড়ার বাসিন্দা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মাস ছয়েক হল আশ্রমে এসেছেন। স্ত্রীকে হারিয়েছেন। কানেও কম শোনেন। নাটকে তিনি হয়েছেন জটাজুটধারী সাধু। ভগ্ন হৃদয় উপেনকে সান্ত্বনা দিয়ে দেশান্তরে নিতে হবে তাকে। আর সেই সময়ে গাইতে হবে, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ।’ মঞ্চে ওঠার আগে সেই সুরটাই গুনগুন করে ভেজে নিচ্ছিছেন তিনি। গম্ভীর মুখে বললেন, ‘‘অভিনয়টা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। তবে ছাড়লে চলবে না। মঞ্চ মাত করে দেব।’’ দর্শকের আসনে তখন বসে রয়েছেন বাঁকুড়ার বিধায়ক শম্পা দরিপা, বাঁকুড়ার পুরপ্রধান মহাপ্রসাদ সেনগুপ্তর মতো অনেকে।

অভিনয়ে সত্যিই মঞ্চ মাত করে দিয়েছিলেন অসিতবাবুরা। যা দেখে মুগ্ধ আশ্রমের কর্তা উজ্বল গঙ্গোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “ওঁদের জীবনের যন্ত্রণাটাই যেন ছিন্নমূল উপেনের মাধ্যে স্পষ্ট দেখতে পেলাম।’’

নরেন্দ্রনাথবাবুর স্ত্রী অপর্নাদেবী এক কালে রীতিমতো গানের চর্চা করতেন। এখন সে সব স্মৃতি। মঞ্চে চেয়ারে বসে তিনি গাইলেন ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম।’ আবাসিকদের গলায় এমন নানা রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বৃদ্ধাশ্রমের চেনা পরিবেশটাকে কিছুক্ষণের জন্য বদলে দিয়েছিল। নরেন্দ্রনাথবাবু বললেন, “ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগে। কোথাও গিয়ে যে একটু আড্ডা দেব, তার উপায় নেই। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে ক’টা দিন বেশ হইচই করে কাটল।’’

তবে ফুরিয়েও তো গেল! অনুষ্ঠান শেষে অ্যাকাডেমির সম্পাদক অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে ধরে অসিতবাবু বললেন, ‘‘এটাই কি তবে শেষ?’’

অরুণাভবাবু আশ্বাস দিয়েছেন, আবারও এ রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন