থিমের বাড়বাড়ন্তেও অমলিন বাড়ির পুজো

পাড়ায় পাড়ায় পুজো মণ্ডপগুলিতে থিমের ছড়াছড়ি। কারও মণ্ডপে চমক, তো কারও সাজসজ্জায়। আবার কেউ কেউ সাবেক প্রতিমায় পুজো করলেও, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে ভিড় টানতে উদ্যোগী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বোলপুর ও দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৩৮
Share:

এই সেই তরোয়াল।—নিজস্ব চিত্র

পাড়ায় পাড়ায় পুজো মণ্ডপগুলিতে থিমের ছড়াছড়ি। কারও মণ্ডপে চমক, তো কারও সাজসজ্জায়। আবার কেউ কেউ সাবেক প্রতিমায় পুজো করলেও, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে ভিড় টানতে উদ্যোগী। থিমে একে অপরকে টেক্কা দেওয়াটাই যেন এখন দস্তুর। থিমকে অস্ত্র করেই প্রতিযোগিতায় নামেন ফি বছর। এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু, সমানে জৌলুস অটুট রেখে চলেছে এলাকার শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি পুজোগুলি।

Advertisement

তরোয়ালে বলি

কয়েক’শো বছরের পুরনো তলোয়ারে বলি হয় চালকুমড়ো। এই তলোয়ারই দুবরাজপুরে হালসোত গ্রামের সরকার বাড়ির পুজোর অন্যতম আকর্ষণ।

Advertisement

এই অস্ত্রের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বীরভূমের ইতিহাস, এমনটাই জানাচ্ছেন সরকার পরিবারের প্রবীণ সদস্য ক্ষেত্রনাথ সরকার। প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক তলোয়ারের কথা তুলতেই ডুব দিলেন স্মৃতিতে। ক্ষেত্রনাথ জানাচ্ছেন, বাপ-ঠাকুরদার মুখে তিনি শুনেছেন, রাজনগরে মুসলিম রাজাদের শাসন শুরুর আগে এক হিন্দুরাজা ছিলেন। যিনি বীর রাজা নামে পরিচিত ছিলেন। বীর রাজার বিশ্বস্ত সৈনিকের দায়িত্ব পালন করতেন এই বংশেরই পূর্বপুরুষ শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এটা তাঁরই তলোয়ার।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অত্যন্ত সাহসী ছিলেন বলে এই বীর রাজাই সরকার উপাধি দেন। পরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময়ে অনুগত শম্ভুনাথকে হত্যা করা হয়েছিল বলেও জনশ্রুতি। বীরভূমের ইতিহাসকাররা লিখেছেন, বীর রাজার স্ত্রী-র সঙ্গে আঁতাতের ফলে রাজাকে হত্যা করেন তাঁর দুই পাঠান সেনাপতি আসাদউল্লা ও জুনেদ খানরা। অনেকে অবশ্য মনে করেন, মল্লযুদ্ধে বীররাজকে পরাজিত করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার ঠাকুর দালানে বসে বৃদ্ধ ক্ষেত্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী মীরাদেবী বলছেন, ‘‘এই তলোয়ার আমাদের পরিবারের উজ্জ্বল অতীত। পুজোর ঠিক আগে কামারশাল গিয়ে শুধু একবার ঘসে নিলেই রুপোর মতো ঝকঝকে হয়ে যায়। চালকুমড়ো বলি হয় এই তলোয়ার দিয়েই। বহু বছর ধরে একই রীতি।’’ বছর চারেক আগে সরকার বাড়িতে ছাগবলির প্রথা ছিল। তখন রামদা ব্যবহৃত হত। পরে অবশ্য বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পুজো দেখভালের দায়িত্ব রয়েছেন ক্ষেত্রনাথবাবুর দুই ছেলে নরেন্দ্রনাথ ও বীরেন্দ্রনাথ। এই পুজো দেখতে দূর দূর থেকে লোকজন আসেন।

১ ঘণ্টার আরতি

প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলা এলাকার ওই বাড়ি পুজোগুলি, বর্তমান সর্বজনীন পুজোর চেহারা নিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীরা চাঁদা দিয়ে পুজোতে শরিক হন না ঠিকই, কিন্তু সংশ্লিষ্ট বাড়ির পুজোতে যেন সমান অধিকার থাকে প্রতিবেশীদের। বহু বছর ধরে বোলপুরের কাছারিপট্টীতে শুধু মাত্র রায় বাড়ির পুজো প্রচলন ছিল। রায় বাড়ির পক্ষে বিবেকানন্দ রায় জানান, প্রয়াত রামজীবন রায় এই পুজো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রায় বাড়ির লোকজন এই পুজোর আয়োজন করলেও, ২০৫ বছরের এই পুজোয় জাতপাতের কোনও ভেদাভেদ নেই।

পারিবারিক রীতি মেনে ওই পুজো বর্তমান অনুপেন্দ্র রায়ের কাঁধে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাশাপাশি বিদেশে রয়েছেন তাঁদের পরিজন। আত্মীয়দের আগমনে, এই পুজো ক’ দিন রায় বাড়িতে চলে মিলন মেলা। রায় পরিবারের প্রয়াত সদস্য নন্দ দুলাল রায় পারিবারিক এই পুজোতে ডাকের সাজ প্রচলন করেন। শাস্ত্র মতে এই পুজোতে সপ্তমীর দিন চাল কুমড়ো বলিদানের প্রথা আজও রয়েছে। রয়েছে এক ঘণ্টা আরতির রেওয়াজও। মহাষ্টমী ও মহানবমীতে ছাগবলি এবং দশমীতে আখ বলির প্রথা রয়েছে।

ডাকের সাজে

অন্যদিকে বোলপুরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের উকিলপট্টীর শতাব্দী প্রাচীন দে বাড়ির দুর্গাপুজো। বৈষ্ণব মতে, প্রাচীন রীতি মেনে চলে পূজা। মাস কলাই বলির প্রথা যেমন রয়েছে তেমনই দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশে পাওয়া পঞ্চমুখি শঙ্খ রয়েছে স্থায়ী মন্দিরে। দেবীর সাবেকী প্রতিমাতে, দে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সাজসজ্জা এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন প্রয়াত যুগল কিশোর দে। বর্তমান ওই বংশের দোদুল কুমার দে কাঁধে পুজোর ভার। প্রতিমাতে মাটির সাজের ওপর চুমকি বসানো থাকে। মহাসপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত নিরন্ত্রর প্রদীপ জ্বলে থাকার বিধি আজও চলে আসছে দে বাড়ির পুজোতে।

বর্ধমানের হুগলি জেলার বাসিন্দা পেশায় আইনজীবী নিত্য গোপাল সেন এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। বোলপুরে হানুবাবুর বাড়ির পুজো বলেই খ্যাত। সেন পরিবারের ওই পুজোতে ডাকের সাজে এক চালার প্রতিমাতে থাকে সোলার কাজ । রীতি মেনে মাস কলাই বলি এবং দশমীর দিন আদিবাসী নৃত্য আজও সমানে হয়ে আসছে। একই ভাবে শতাব্দী প্রাচীন দালাল বাড়ির পুজো। জমিদার তথা বস্ত্র ব্যবসায়ী রমণ চন্দ্র দালাল পুজোর প্রচলন করেছিলেন। ডাকের সাজ মাটির প্রতিমায় থাকে সোনালি কাজও।

বৈষ্ণব মতে পুজো, মাস কলাই বলি এবং কাঁধে করে দেবীর বিসর্জন প্রথা ছিল। এ বছর অবশ্য দেবীকে গাড়িতে নিয়ে বিসর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দালাল পরিবার। বর্তমান ওই পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের জ্যোতির্ময় দালালের কাঁধে পুজোর ভার। বোলপুরের গা ঘেঁষে, সুরুল সরকার বাড়ির পুজো বহু প্রাচীন। এলাকায় সুবিদিত। বড় ও ছোট সরকার বাড়ির পুজোর জৌলুস আজও বিদ্যামান। দেশে ও বিদেশে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন শরিক হন ওই পুজোতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন