হারিয়েছে গান, নামে টিকে পালকিপাড়া

নানুরের উচকরণ বাউড়ি পাড়ায় বাস সুকুমার বাউড়িদের। এক সময় ৪৫টি পরিবার ওই পাড়াতেই থাকতেন। প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক পুরুষ পালকি বাহকের কাজ করতেন। তাদের অন্যতম প্রধান জীবিকাই ছিল পালকি বহন।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

নানুর শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮ ০৭:২০
Share:

অতীত: এ ভাবেই পড়ে পালকি। নানুরে। ছবি: কল্যাণ আচার্য

শিশুপাঠ্য থেকে কবেই উধাও হয়েছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকির গান’। অনভ্যাসে পালকি বাহকেরাও ভুলতে বসেছেন তাদের নিজস্ব ঘরানার গান। শুধু তাঁদের পাড়ায় মাঝে মধ্যে বাজে হাল আমলের ‘পালকিতে বউ চলে যায়’ গানটি। ওই গান শুনে অন্য জগতে চলে যান নানুরের পালকি পাড়ার সুকুমার বাউড়ি, মহাদেব বাউড়িরা।

Advertisement

তাঁদের কথায়, যুগের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পালকির প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে গিয়েছে। তবু পুরনো দিনের সেই খেতাব আজও থেকে গিয়েছে পালকি পাড়ায়। ওই খেতাবই নষ্টালজিক করে তোলে সুকুমার বাউরিদের। নানুরের উচকরণ বাউড়ি পাড়ায় বাস সুকুমার বাউড়িদের। এক সময় ৪৫টি পরিবার ওই পাড়াতেই থাকতেন। প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক পুরুষ পালকি বাহকের কাজ করতেন। তাদের অন্যতম প্রধান জীবিকাই ছিল পালকি বহন। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায়, আজ পালকি অবলুপ্তপ্রায়। কালেভদ্রে এখন পালকি বহনের ডাক আসে। জীবিকা হারিয়ে পালকি বাহকেরা আজ দিনমজুরি করছেন। কিন্তু, আজও তাঁদের বাপ-ঠাকুরদার পেশার চিহ্ন বহন করে চলেছে পালকি পাড়ার খেতাব।

ওই পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা কানন বাউরি বলেন, ‘‘বছর ১৫ থেকে ২০ আগেও পালকির বায়না করতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসতেন। গ্রামে ঢুকেই জিজ্ঞেস করতেন, পালকি পাড়াটা কোন দিকে? এখন পালকির চাহিদা না থাকলেও আমাদের এই পাড়াটিকেই পালকিপাড়া হিসেবেই চেনেন সকলেই।’’

Advertisement

ডাক পেলে এখনও পালকি ঘাড়ে তোলেন লক্ষণ বাউড়ি, সুকুমার বাউড়িরা। তাঁদের কথায়, ‘‘মূলত অর্থের অভাবে ভাবের জন্য বাহকদের নিজস্ব কোনও পালকি ছিল না। কিন্তু বিয়ে, দ্বিরাগমন, গঙ্গাস্নান, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যাওয়া-আসার জন্য বায়না তো বটেই রাতবিরেতে কবিরাজ কিংবা হাসপাতাল যাওয়ার জন্য সকলেই আমাদের কাছেই আসতেন। আমরা সেই মতো পালকি মালিকেরও বায়না করতাম। গ্রামে সে সময় ৮ থেকে ১০টি পালকি ছিল। বাইরের গ্রাম থেকেও পালকি ভাড়া করে আনা হতো। জমিদারবাড়ির নিজস্ব পালকি বহনের জন্যও ডাক পড়ত। কিন্তু সে সব এখন অতীত!’’

কেমন রোজগার হতো? প্রশ্ন শুনেই স্মৃতিতে ডুব দেন বাহাত্তর বছরের ক্ষুদিরাম বাউড়ি, পঁয়ষট্টি বছরের কানন বাউড়িরা। জানালেন পুরনো দিনের সেই কথা। একটি পালকির জন্য মূলত ৬ জন বাহক প্রয়োজন। কিন্তু, একটানা বহন থেকে কিছুটা বিশ্রাম পেতে অতিরিক্ত আরও দু’জনকে রাখা হতো। থাকতেন একজন সর্দার। বায়না ধরা, সেই অনুযায়ী পালকি বায়না করা-সহ দলের বিবাদ মেটানোর গুরু দায়িত্ব পালন করতে হতো সর্দারকে। দূরত্ব অনুযায়ী পারিশ্রমিক মিলত ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। কাছে-পিঠে হলে একই দিনে একাধিক ভাড়া খাটাও যেত। পালকি মালিককে প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য ২০-৩০ টাকা ভাড়া দিতে হতো। সব মিলিয়ে দিনমজুরের সমানও আয় হতো না!’’

এত কম আয়ের ওই পেশার প্রতি কেন আজও এত টান? তাঁরা বলেন, ‘‘পালকি বাহকেরা জানান, শুধু আয়ই নয়, এই পেশায় তেমন কোন সম্মানও নেই। বহু ক্ষেত্রে গোয়ালঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। খাওয়া জুটেছে সবার শেষে। তবু বিয়ের মরসুম এলেই মন যেন কেমন করে। আসলে বাপ-ঠাকুরদার পেশা যেন আজও আমাদের রক্তে মিশে রয়েছে। এ যেন, মেলায় মেলায় ঘোরা সেইসব দোকানদারদের নেশার মতো। বিক্রি-বাটা কিংবা লাভ হোক বা নাই হোক মেলায় দোকান দেওয়া চাই।’’ তাঁদের আক্ষেপ, ‘‘আজ আর পালকির সেই চাহিদা নেই। এক ফোনেই ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে চার চাকার গাড়িও। গ্রামের শেষতম পালকিটিও ভগ্নপ্রায়। অনভ্যাসে বর্তমান প্রজন্মের বাহকেরা ভুলতে বসেছেন তাঁদের নিজস্ব ঘরনার পালকির গান। তবু হালফিলে ‘পালকিতে বউ চলে যায়’ গান শুনে আজও মন উড়ু উড়ু করে পালকি বাহকদের।’’ সুনীল বাউরি, অশোক বাউরিরা বলেন, ‘‘ছোটবেলায় স্কুলে আমরাও পালকির গান মুখস্ত করেছি। হাল আমলের গানও শুনেছি। দু’টি গানই আমাদের পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু, আমাদের গান ছিল স্বতন্ত্র। চলার গতির ধারাবাহিকতা রক্ষার পাশাপাশি উপরি অর্থ পাওয়ার লোভে কর্তা-কর্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য মুখে মুখে গান বেঁধে শ্লোগানের আদলে গাওয়া হতো।’’

কেমন ছিল সেই সব গান? পালকি বাহকেরা জানান, কর্ত্রীকে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়ার সময় গাওয়া হতো, ‘কর্তাবাবুর রঙটি কালো, গিন্নি মায়ের মনটি ভাল। সামলে চলো হেঁইও’। আবার কর্তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার সময় বাইকেরা গাইতেন, ‘হেঁইও জোয়ান সরু আল চলো ধীরে, কর্তাবাবুর দরাজ দিল দেবে চিঁড়ে’।

সব আজ ইতিহাস! জীবিকা হারিয়ে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী পালকি বাহকেরা আজ শুধুই দিনমজুর। তাঁদের আক্ষেপ, ভর্তুকিযুক্ত ঋণ পেলে তারা বিকল্প জীবিকা খুঁজে নিতে পারতেন। কিন্তু, তার নাগাল মেলেনি। নানুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বাণী সাহা বলেন, ‘‘ওই সব পালকি বাহকদের কথা জানা ছিল না। তাঁরা লিখিতভাবে জানালে সরকারি নিয়মনীতি মেনে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন