কয়েক দিন আগেই মহারাষ্ট্রে আস্ত সেতু ভেঙে প্রাণ গিয়েছে বহু মানুষের। দু’দিন আগে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল হিমাচল প্রদেশের সেতু ধসে পড়ার দৃশ্যও। দু’টি ঘটনাতেই আতঙ্ক কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে হেতমপুর রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মনে। স্কুল আসার পথে শতাব্দী প্রাচীন এক সুড়ঙ্গই ঘুম ছুটিয়েছে তাদের। জীর্ণ ফাটল ধরা ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ওই সুরঙ্গের ছাদ থেকে অহরহ খসে পড়ছে টালি। নুইয়ে পড়েছে কড়ি-বরগা। যে কোনও মুহূর্তে আস্ত নির্মাণটাই যে কারও মাথার উপর ভেঙে পড়তে পারে।
অথচ যে পথ পেরিয়ে শিক্ষক এবং প্রায় আটশো স্কুল পড়ুয়া নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করেন, যে পথ ব্যবহার করেন কয়েক হাজার এলাকাবাসী— সেই পথ সংস্কার করার কেন কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না প্রশাসন, প্রশ্ন উঠেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় কেন্দুলা, বাজিতপুর ও হেতমপুর গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, বহু আবেদনের ফলে বছর খানেক আগে ‘এই পথ ঝুঁকিপূর্ণ’ জানিয়ে একটি নোটিস ঝুলিয়েই দায় সেরেছিল প্রশাসন। কিন্তু ওই পথের বিকল্প তৈরিতে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলেই অভিযোগ।
ঘটনা হল, হেতমপুর রাজ পরিবারের রাধাবল্লভ মন্দির সংলগ্ন বিশাল ওই ভবনটিতেই রয়েছে হেতমপুর উচ্চ বিদ্যালয়। অতীতে সেটাই ছিল হেতমপুর রাজাদের আদি রাজবাড়ি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে দুই শতাব্দীরও বেশি আগে তৈরি হয়েছিল ভবনটি। তবে ১৮৬৯ সালে হেতমপুরের রাজা রামরঞ্জনের প্রতিষ্ঠিত রাজ উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রথম পথ চলা শুরু করেছিল, বর্তমানে যেখানে হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ রয়েছে, সেই প্রাঙ্গণে। ১৯০৩ সালে তৈরি হয় নতুন রাজবাড়ি। পরে ষাটের দশকে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে স্কুলটিকে স্থানান্তরিত করা হয় রাজ পরিবারের ছেড়ে যাওয়া এই আদি রাজবাড়িতে। সেই ভবনের নির্মাণ এমন যে, স্কুলে আসার পথেই রয়েছে ওই সুড়ঙ্গপথ বা ট্যানেল। সুড়ঙ্গপথে ঢুকলেই বাঁ দিকে রাধাবল্লভ মন্দির এবং ডান দিকে রাজ পরিবারের এক সময়ের হাতিশাল। বর্তমানে সেটি স্কুলের মিড-ডে মিলের ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সুড়ঙ্গপথ শেষ হলেই স্কুলে ঢোকার মূল দরজা।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, গত বছর গ্রীষ্মাবকাশের সময় থেকেই ওই পথটি বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। স্কুলছুটির সময়েই স্কুল জানতে পারে যে একটি সুড়ঙ্গের বরগা ভেঙে পড়েছে। তার আগেই অবশ্য সুড়ঙ্গপথের উপরে থাকা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ ভাবে করি বরগা, টালি ভেঙে পড়তে থাকায় বিষয়টি স্থানীয় হেতমপুর পঞ্চায়েত এবং দুবরাজপুরের বিডিও-কে লিখিত ভাবে জানানো হয়। ত্রিপাক্ষিক বৈঠক পরে দুবরাজপুরের তৎকালীন বিডিও সুশান্ত বালা বিপজ্জনক ঘোষণা করে পথটি বন্ধের নির্দেশ দেন। সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ছিল, দ্রুত রাস্তাটি বিপদমুক্ত করে চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে।
কিন্তু গত বর্ষা পেরিয়ে এ বার বর্ষাও মাঝামাঝিতে পৌঁছলেও এক ফোঁটা কাজ এগোয়নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তপনকুমার সাধু, সহকারি প্রধান শিক্ষক আচিন্ত্যকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলছেন, ‘‘দিন কয়েক আগে বর্তমান বিডিও বনমালি রায়ও দেখে গিয়েছেন। কিন্তু কবে যে সংস্কার হবে, জানাননি। প্রশাসনের সাহায্য না পেলে যে কোনও দিন বড় বিপদ ঘটে যাবে। তখন আফশোসের সীমা থাকবে না।’’ স্কুলের শিক্ষকদের একাংশের বক্তব্য, স্কুলেরই অংশ হওয়ায় কোনও বিপদ ঘটলে, তার দায় আদতে স্কুলের উপরেই বর্তাবে।
বিপদ যে যে কোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে, তা পড়ুয়াদের কথাতেও পরিষ্কার। দ্বাদশ শ্রেণির প্রিয়া সালুই, অনুভব পাল, রবিলাল দাস বা একাদশ শ্রেণির নাজমুন্নেসা খাতুনরা বলছে, ‘‘এই তো সে দিন, স্কুলে আসছিলাম। হঠাৎ-ই একটা বড় টালি খসে পড়ল। ভাগ্যিস মাথায় পড়েনি! কোন দিন যে কী হবে, বলা মুশকিল।’’ স্কুলে ঢোকার কি অন্য কোনও পথ নেই? পড়ুয়ারা জানাচ্ছে, পায়ে চলার একটি পথ রয়েছে। তবে, সেটাও অনেকটা ঘুরে। পড়ুয়াদের সঙ্গে একমত হেতমপুরের উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিমল ঠাকুর, তাপস চট্টরাজ, কেন্দুলাগ্রামের দিলীপ দাস, শেখ মহিউদ্দিনরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘পথটা সত্যিই বিপজ্জনক। কিন্তু বিকল্প রাস্তার অভাবেই ওই পথ দিয়ে যেতে হয়।’’
সুড়ঙ্গপথটি যে বিপজ্জনক, তা মেনে নিয়েছেন দুবরাজপুরের বর্তমান বিডিও বনমালি রায়। তিনি বলেন, ‘‘ওই নির্মাণটি একটি হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের মধ্যে পড়ে। তাই দুম করে তা ভেঙে ফেলা যাবে না। আমরা এমন কোনও মধ্যবর্তী ব্যবস্থা করতে চাইছি, যাতে বিল্ডিংটিও রইল অথচ পথটিকে বিপদমুক্ত করা গেল।’’ তাঁর আরও আশ্বাস, এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু হবে।