ভোটের প্রচারে দেদার খরচ, সৌজন্যের দোহাই প্রার্থীদের

শহরের পাঁচমাথা মোড়। সেখানেই চোখে পড়বে পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী জালালউদ্দিন শেখের সমর্থনে ২০ ফুট বাই ১০ ফুট প্রমাণ সাইজের প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর সঙ্গে তাঁর ফ্লেক্স। জালালউদ্দিন ব্যতিক্রম নন, সব রাজনৈতিক দলেরই এমন ফ্লেক্স ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছে রামপুরহাট শহরের প্রধান রাজপথ থেকে গলি। আর প্রশ্নটা উঠছে সেখানেই। অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনের নির্ধারণ করে দেওয়া খরচের থেকেও ঢের বেশ খরচ করছেন প্রার্থীরা।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫৭
Share:

এমন সব হোর্ডিংয়েই ছেয়ে গিয়েছে শহর। —নিজস্ব চিত্র।

শহরের পাঁচমাথা মোড়। সেখানেই চোখে পড়বে পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী জালালউদ্দিন শেখের সমর্থনে ২০ ফুট বাই ১০ ফুট প্রমাণ সাইজের প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর সঙ্গে তাঁর ফ্লেক্স।

Advertisement

জালালউদ্দিন ব্যতিক্রম নন, সব রাজনৈতিক দলেরই এমন ফ্লেক্স ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছে রামপুরহাট শহরের প্রধান রাজপথ থেকে গলি। আর প্রশ্নটা উঠছে সেখানেই। অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনের নির্ধারণ করে দেওয়া খরচের থেকেও ঢের বেশ খরচ করছেন প্রার্থীরা। কারও কারও ক্ষেত্রে তা লক্ষ টাকাও ছড়িয়েছে। আর সে ক্ষেত্রেই নিজেদের দায় এড়াচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি।

কিন্তু, কমিশনের বিধি ভেঙে কি রাজনৈতিক দলগুলি এমন লাগাম ছাড়া খরচ করতে পারে? পশ্চিমবঙ্গ পুর নির্বাচন আইনের ৭২ ধারায় বলা হয়েছে, পুরভোটের ক্ষেত্রে যে ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৬ হাজারের মধ্যে সেখানে এক জন প্রার্থী প্রচার খাতে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে পারেন। দশ হাজার ভোটার সংখ্যা হলে সেই অঙ্ক ধার্য করা রয়েছে ৬০ হাজার টাকা।

Advertisement

ঘটনা হল, বিধি থাকলেও তা ভাঙার দেদার নজিরও মিলছে। ফ্লেক্স-ফেস্টুন-ব্যানারে সব দলেরই খরচই লাগাম ছাড়া। নির্বাচনের ঘোষণার দিন ঘোষণার আগে থেকেই এলাকায় দেওয়াল লিখন শুরু হয়েছে। চলছে কর্মীদের সকাল সন্ধে টিফিন, চা। এর সঙ্গে মিছিলে লোক আনার খরচও আছে। সভায় মাইকের খরচ, প্রতীক আঁকা গেঞ্জি, শাড়ি বিলির মতো (এই খাতে ক্লাবে ক্যারাম, খেলার সরঞ্জামও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ) হাজারও খরচ চালিয়ে কী ভাবে শহরে এত ফ্লেক্স-ফেস্টুন-ব্যানার লাগাতে পারছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল? অথচ ঘটনা হল, এই পুরসভার ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে কোনও ওয়ার্ডেই ভোটার সংখ্যা ৬ হাজার নয়!

শহরে বিজেপি-র ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী বাপ্পা রায়ের সমর্থনে সৌজন্যমূলক বড় ফ্লেক্স, হোর্ডিংও সকলের নজর কেড়েছে। বাপ্পাবাবু বলছেন, ‘‘একটা ফেক্সে লোহার রড দিতে হয়েছে। তাতে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’’ তাঁর সমর্থনে এমন ফ্লেক্স ওয়ার্ডে দু’টি জায়গায় দেওয়া হয়েছে। আবার ওই ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী বিদায়ী পুরপ্রধান অশ্বিনী তেওয়ারির নামে বড় বড় ফেক্স-হোর্ডিং টাঙানো হয়েছে। সবগুলিই সৌজন্যমূলক! বাদ যায়নি ৬ নম্বর ওয়ার্ডও। এখানেও বিজেপি ও তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে ওয়ার্ডজুড়ে রয়েছে বড় বড় ফ্লেক্স। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডেও নজরে পড়ে কংগ্রেস প্রার্থী আনারুল হকের সঙ্গে জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির যুগলবন্দিতে বড় বড় ফ্লেক্স-হোর্ডিং। যা তৃণমূল প্রার্থী সুকান্ত সরকারের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে। সে দিক থেকে এ বার বামফ্রন্ট প্রার্থীদের ফ্লেক্স-ব্যানার বেশ কম। কেবল মাত্র ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী হারাধন মিত্র ওয়ার্ডজুড়ে বেশ কয়েকটি ফেক্স টাঙিয়েছেন। এ ছাড়া ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী সঞ্জীব মল্লিক রিকশার পিছনে ফ্লেক্স টাঙিয়ে প্রচার করেছেন। তবে, খরচের ব্যাপারে পিছিয়ে নেই নির্দল প্রার্থীরা।

তৃণমূলে সূত্রের খবর, রামপুরহাটে ইতিমধ্যেই দলীয় প্রার্থীদের তিন দফায় ৭৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ফ্লেক্স, ফেস্টুন, পতাকার খরচ রয়েছে। দেওয়াল লিখতে শুধু রং তুলি বাবদই খরচ গড়ে ১০ হাজার টাকা। আবার কংগ্রেস সূত্রের দাবি, দলীয় প্রার্থীদের এখনও টাকা দেওয়া হয়নি। বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে প্রার্থীরা খরচ করছেন। বিজেপি-রও দাবি, এখনও দলের পক্ষ থেকে কোনও টাকাই প্রার্থীদের দেওয়া হয়নি। দল টাকা দেয়নি, এমন তথ্য দিচ্ছে বামফ্রন্টও। বামেদের দাবি, প্রার্থীদের হাতে দলের রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এ বার। রসিদ কেটে চাঁদা তুলে প্রার্থীদের ভোটের খরচ জোগাড় করতে বলা হয়েছে।

ঠিক কেমন খরচ হয়েছে ফ্লেক্স-ফেস্টুন-ব্যানার লাগাতে দলগুলির?

কংগ্রেস প্রার্থী জালালউদ্দিন শেখের সমর্থনে টাঙানো ওই ফ্লেক্সের খরচ কত? জালালউদ্দিনের দাবি, ‘‘বর্গ ফুট পিছু ৬ টাকা করে নিয়েছে।’’ অর্থাৎ প্রতিটি ফ্লেক্স তাঁর ১,২০০ টাকা করে খরচ হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো রাজনীতিতে নতুন। দল এ সব ব্যাপারে ভাল বলতে পারবে।’’ এ দিকে, ১০ নম্বর ওয়ার্ডেই তৃণমূল এবং কংগ্রেস প্রার্থীর প্রমাণ সাইজের বড় হোর্ডিং ব্যানার ফ্লেক্সের বাহুল্য এলাকায় রীতিমতো দৃশ্যদূষণ তৈরি করেছে। শহরের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী সুকান্ত সরকার বাড়তি খরচের অভিযোগ শুনে বললেন, ‘‘সঠিক তথ্য নয়। কারণ, আমি তো জানি এক একটা ফেক্স, ফেস্টুনে কী ধরনের খরচ!’’ সুকান্তবাবুর মতো অনেক তৃণমূল প্রার্থীই ফ্লাগ ফেস্টুন ব্যানারের খরচ জানাতে চাননি।

রামপুরহাট মহকুমাশাসক উমাশঙ্কর এস বলেন, ‘‘নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী, রামপুরহাট পুরসভার ক্ষেত্রে প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রার্থীরা ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন। তার বেশি খরচ করা যায় না।’’ ঘটনা হল, প্রার্থীদের এই খরচের হিসাব, নির্বাচন পর্ব মিটে যাওয়ার পরে জমা দিতে হয়। আর সেই আইনের ফাঁক গলেই অধিকাংশ প্রার্থীর ফ্লেক্স-ফেস্টুনের ব্যানারের খরচ হয়ে যায় ‘সৌজন্যমূলক’! মহকুমাশাসক জানান, ইতিমধ্যেই প্রার্থীদের একাধিক বার সর্বদলীয় সভায় নির্বাচন বিধি নিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, কোনও দলই ব্যানার, ফ্লেক্স, ফেস্টুন, হোর্ডিং নিয়ে আপত্তি জানায়নি। উল্টে, সমস্ত দল প্রচারের জন্য ব্যানার, ফ্লেক্স, হোর্ডিংয়ের ব্যবহারকে সমর্থন জানিয়েছে। তবে, নির্বাচনের আগের দিনই বুথ কেন্দ্রের ১০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে থাকা যাবতীয় ফ্লেক্স, ফ্ল‌্যাগ, ফেস্টুন, ব্যানার, হোর্ডিং সরিয়ে দেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

অন্য দিকে, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, ‘‘আসলে কোনও পক্ষ থেকে অভিযোগ আসলে সেটা খতিয়ে দেখে নির্বাচন কমিশনের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হয়। আর প্রার্থীরা তো তাঁদের নির্বাচনের খরচ ভোটের পর জমা করবেন। তার আগে কী করে বোঝা যাবে যে প্রার্থী কী খরচ করছেন!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন