লাক্ষা চাষে উৎসাহ দিচ্ছেন গবেষকরা

পড়শি জেলা পুরুলিয়ার বলরামপুরের দিকে একটি প্রচলিত বাক্য আছে, ‘‘বিয়েতে পণ লাগবে না, একটি কুসুম গাছ দিও।’’ কেন না, একটা পরিণত কুসুম গাছই বদলে দিতে পারে একটি পরিবারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ০১:০০
Share:

সিউড়ির সেকমপুরে বিধানচন্দ্র কৃষি বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে লাক্ষা চাষ। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

পড়শি জেলা পুরুলিয়ার বলরামপুরের দিকে একটি প্রচলিত বাক্য আছে, ‘‘বিয়েতে পণ লাগবে না, একটি কুসুম গাছ দিও।’’

Advertisement

কেন না, একটা পরিণত কুসুম গাছই বদলে দিতে পারে একটি পরিবারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো। উপায়, ওই গাছে লাক্ষা চাষ। লাক্ষা চাষ অর্থকরী এবং কুসুম গাছেই সবচেয়ে ভালমানের লাক্ষা চাষ সম্ভব।

নাই-বা থাকল কুসুম গাছ!

Advertisement

বাড়ির উঠোনে বা চার পাশে ছড়িয়ে থাকা কুল গাছেও সফল ভাবে লাক্ষা চাষ করা যায়। এবং প্রকৃত দোসর হতে পারে সেমিয়ালতা নামে একটি সিম জাতীয় গাছও। বলছেন, সিউড়ি ২ ব্লকের সেকমপুরে থাকা বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক গবেষণাকেন্দ্রের অধিকর্তা তথা কৃষি বিশেষজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ পার্থপ্রতীম ধর এবং আশিস চক্রবর্তীরা। তাঁরা এ কথা শুধু মুখে বলছেন না, হাতে কলমে গবেষণা কেন্দ্রের অধীনে থাকা জমিতে কুল ও সেমিয়ালতা গাছে সফলভাবে লাক্ষা চাষ করে দেখিয়েছেন তাঁরা।

আদতে লাক্ষা ঠিক কী?

লাক্ষা হল, একধরনের ক্ষুদ্র কীট। গাছের ডালে আটকে থেকে এবং রস খেয়ে ওই পোকাগুলি একধরনের রেজিন উৎপাদন করে (লাক্ষা পোকার শরীরের উপরে অবস্থিত এক ধরনের মোম জাতীয় আঁশের অ্যালকোহলের দ্রবণ)। বিভিন্ন কাজে ওই রেজিন বা লাক্ষা ব্যবহৃত হয়। যেমন, স্বর্ণের গহনায় ফাঁপা অংশে, খেলনা বানানোর কাজে, সীল মোহরের কাজে(গালা),বার্ণিশের কাজে, প্রসাধনী দ্রব্যের কাজে, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির কাজে, লিথোগ্রাফিক কালি তৈরির কাজে। লাক্ষার বিভিন্নমুখী ব্যবহারের জন্য শুধু দেশের বাজারেই নয়, বিশ্বের বাজারেও এর চাহিদা রয়েছে।

যেহেতু আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্রগুলির উদ্দেশ্যই এলাকার চাষিদের সমস্যা হলে পরামর্শ দেওয়া সেই কারণেই এ জেলায় লাক্ষা চাষ করা যায় কিনা সেটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেন সিউড়ি গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপকেরা। অধিকর্তা তথা কৃষি বিশেষজ্ঞ আশিস চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘লাভজনক এই চাষ শুধু পুরুলিয়া বাঁকুড়া জেলা নয় এই জেলাতেও সম্ভব। ব্রিটিশ আমলে এই জেলায় লাক্ষা চাষের ইতিহাস রয়েছে। তবে নগরায়ণ ও গাছ কমে যাওয়ার পর লাক্ষা চাষ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’

গবেষণা বলছে, কুসুম, কুল ছাড়াও শিরিস, বট, পাকুড়, পলাশ, ইত্যাদি গাছে লাক্ষা চাষ সম্ভব। মূলত দুটি প্রজাতির লাক্ষা রয়েছে। রঙ্গিনী ও কুসুমী। রঙ্গিনী পলাশ গাছে বেশি হয়, মানের দিক থেকে এগিয়ে কুসুমী। এই প্রজাতির লাক্ষা মূলত কুসুম ও কুল গাছে হতে পারে এটা মাথায় রেথে প্রথমে কুল (এই গাছে লাক্ষা চাষ এমনিতেই করা সম্ভব) গাছে চাষ শুরু করেছিলেন আশিসবাবুরা।

কারণ, কুল লাক্ষা উৎপাদনের পাশাপাশি ফলও দিতে পারে। কিন্তু কুল গাছ বড় হতে সময় লাগে। এবং কুল লাগানোর জন্য বেশি জায়গার প্রয়োজন। কুসুমের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বড়। কেন না কুসুম গাছ বড় হতেই বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। জায়গাও বেশি প্রয়োজন। এটা ধরে নিয়ে সেমিয়ালতা (মূলত অসম ও নেপালে এই গাছগুলি দেখতে পাওয়া যায়) নামে একটি সিম জাতীয় গাছে লাক্ষা চাষের পরিকল্পনা করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঘটনা হল, সেমিয়ালতাকে বেছে নেওয়ার পিছনে দুটো সুবিধার কথা মাথায় রেখেছিলেন বিশেজ্ঞরা। এক, ছোট আকারের গাছগুলিতে চাষ করার তুলনায় সহজ এবং একটি বাগানের মধ্যে লাক্ষা চাষ করা সম্ভব। দুই, সিমগত্রীয় বলে নাইট্রোজেনঘটিত অভাব দূর হয়, জমির উর্বরতাও বৃদ্ধি পাবে। এতে তাঁরা সফল, বলছেন অধিকর্তা অশিসবাবু ও কীটতত্ত্ববিদ পার্থপ্রতীমবাবু।

তাঁরা বলেন, ‘‘এখন এমন একটা জায়গায় পৌঁচেছি, জেলায় উৎসাহী চাষি আমাদের কাছে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ চাইলে সহজেই তা দিতে পারি। দ্বিতীয়ত লাক্ষাবীজ সংগ্রহের জন্যও অন্য জেলায় যেতে হবে না চাষিকে। জেলায় অনেক পতিত জমি রয়েছে সেখানে শুধু সেমিয়ালতায় অথবা কুল ও সেমিয়ালতায় মিলিতভাবে লাক্ষা চাষ করতে লাভের মুখ দেখতে পারেন উৎসাহী চাষিরা। বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে এই চাষ ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। পরিবারের মেয়েরাও সফলভাবে লাক্ষা চাষ করে পরিবারকে অর্থ সাহায্য করতে পারবে।’’

কিন্তু কোনও প্রান্তিক অঞ্চলের কোনও চাষি লাক্ষা চাষে সমস্যায় পড়লে, কোন পথে এগোবেন আঞ্চলিক গবেষণাকেন্দ্রের অধ্যাপকেরা?

তাঁদের মত, জেলার সব অংশের ইচ্ছুক চাষির কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সহজ নয়। এখানেই প্রয়োজন জোলাপ্রশাসন বা সরকারি উদ্যোগ। এর আগে একশো দিনের প্রকল্পে লাক্ষা চাষে এমন উদ্যোগী হতে দেখা গিয়েছে উত্তর দিনাজপুর জেলা প্রশাসনকে।

বছর তিনেক আগে বালুরঘাট ব্লকের চকভৃগু গ্রাম পঞ্চায়েতের চকরামানাত ও মৌস্তাফাপুর মৌজায় ২৫ একর জমি জমিতে লাক্ষার মতো বিকল্প চাষের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক উন্নতির চেষ্টা করা হয়েছিল। চকভৃগুতে আদিবাসী কৃষকদের প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। অন্য জেলাতেও এমন পদক্ষেপ বা সরকারি সহায়তা চাষিরা পেয়েছেন। বীরভূমের ক্ষেত্রেও কী তেমন হবে?

জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, ‘‘যদি এমন সম্ভাবনা থাকে তবে সেটা অবশ্যই যাচাই করে দেখা যেতে পারে। আমি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন