ঐতিহ্যের মহিমায় অমলিন মানভূমের গ্রাম দেবতারা

নৃতত্ববিদরা বলেন, গ্রাম একটি সামাজিক একক। তার যেমন একটি ভৌগলিক এলাকা থাকে, মানুষজনের পেশা-পরিচিতি থাকে, থাকে ধর্মীয় বিভিন্ন চিহ্নও। গ্রাম দেবতা তেমনই।

Advertisement

সমীর দত্ত

মানবাজার শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৬:২০
Share:

পুজো: মানবাজার থানার গোলকিডি গ্রামে। নিজস্ব চিত্র

গ্রাম দেবতার পুজো দিয়ে মাঘের শুরু হল পুরুলিয়া এবং লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন এলাকায়। সোমবার জেলার বিভিন্ন গ্রামে এই পুজো হয়েছে কালাচিনি, ভৈরব ঠাকুরের মতো বিভিন্ন লৌকিক দেবতার।

Advertisement

নৃতত্ববিদরা বলেন, গ্রাম একটি সামাজিক একক। তার যেমন একটি ভৌগলিক এলাকা থাকে, মানুষজনের পেশা-পরিচিতি থাকে, থাকে ধর্মীয় বিভিন্ন চিহ্নও। গ্রাম দেবতা তেমনই। এক সময়ে গ্রামে গ্রামে থাকত চণ্ডীমণ্ডপ। তা শুধুই ধর্মীয় জায়গা না। চণ্ডীমণ্ডপে বসত আড্ডা। হতো গ্রাম্য বিচার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সেই ছবিটা হারিয়ে গিয়েছে। তবে গ্রাম দেবতার পুজো এখনও ধরে রেখেছে পুরুলিয়া।

বান্দোয়ানে শঙ্কর ডুংরিতে সোমবার গ্রাম পুজো উপলক্ষে মেলা বসেছিল। বান্দোয়ানের চাঁদড়া গ্রামের বাসিন্দা জগদীশ মাহাতো জানান, সকাল থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত টটকো, বেকো, শঙ্কর ডুংরি, চিরুডির মতো বিভিন্ন জায়গাতেও জমে উঠেছিল গ্রাম পুজোর মেলা।

Advertisement

এ দিন মানবাজার থানার গোলকিডি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, মহিলারা স্নান সেরে ঝুরি নামা প্রাচীন গাছের তলায় পুজো দিতে এসেছেন। উপকরণ বলতে সিঁদুর, ধূপ, ঘি, মধু, দূর্বা, আতপ চাল, কলা, চিঁড়ে— এই সমস্ত। সঙ্গে মাটির ঘোড়া। মানভূম কলেজের শিক্ষক তথা জেলার লোকগবেষক তপন পাত্র জানান, অনেকে বিশ্বাস করেন ঘোড়ায় চড়ে দেবতা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন। সেই জন্য পুজোয় মাটির ঘোড়া দেওয়ার প্রথা।

ওই গবেষক জানান, গ্রামের সামাজিক বন্ধন নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার জন্যই বছরের নির্দিষ্ট সময়ে মেলা, পুজো ইত্যাদি হয়। আর যা কিছু ভেদাভেদ, তা ভুলে সবাই সেই আয়োজনে সামিল হন। অনেকে কাজের জন্য বাইরে থাকেন, কারও বিয়ে হয়ে এখন ভিন্গ্রামে থিতু— তাঁরা আসেন ফিরে। মোদ্দা কথায়, অন্য অনেক কারণে সবাই আলাদা আলাদা ভাবে বাঁচলেও, গ্রামের সূত্রে যে তাঁরা এক, সেই বিশ্বাসের ঝালাই হয়। এ ভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম থিতু থাকে জনপদ।

সাঁওতালি সংস্কৃতিতে ১ মাঘ নববর্ষ। জেলার বিশিষ্ট সাঁওতালি লেখক ও গবেষক মহাদেব হাঁসদা বলেন, ‘‘সাঁওতাল সমাজে এই দিনটি নববর্ষ হিসাবে পালন করার প্রথা রয়েছে। প্রাচীন সময়ে জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করা হতো। গ্রাম পত্তন করতে হলে আগে গ্রাম দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে হয়। সেই রেওয়াজ মেনে এখনও পুরুলিয়ার বহু গ্রামে সোমবার গ্রাম দেবতা বা গরাম দেবতার পুজো হয়েছে।’’

ক্রমশ কি হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন এই সংস্কৃতি?

তপনবাবু বলেন, ‘‘পুরুলিয়া তথা সাবেক মানভূমে বিনিময় প্রথা চালু ছিল। ধোপা, নাপিত, বাগাল, ধাত্রী মা— সবাই সারা বছর ধানের বিনিময়ে কাজ করতেন। এই দিনে তাঁদের সঙ্গে কাজের নতুন চুক্তি হতো। কালের নিয়মে ওই প্রথার বিলুপ্তি ঘটছে। কিন্তু আচারে অনুষ্ঠানে সেই ধারা প্রতীকি ভাবে রয়ে গিয়েছে।’’

বোরো থানার মলিয়ান গ্রামের হংসেশ্বর মাহাতো রাজনৈতিক নেতা। পাশাপাশি লোকসংস্কৃতি অনুসন্ধিৎসুও। তিনি বলেন, ‘‘এই এলাকার মানুষ মূলত শ্রমজীবী। জল, জমি আর জঙ্গল নিয়ে তাঁদের জীবন সংগ্রাম। গ্রাম দেবতার পুজোর দীর্ঘদিনের সেই বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ছাপ বয়ে নিয়ে চলেছে। সময়ের ঝাপটে এক কথায় এই সংস্কৃতি ক্ষয়ে যেতে পারে না।’’

লোক সংস্কৃতির গবেষকেরাও জানাচ্ছেন, সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে আচারের অদলবদল হয়। কিন্তু সংস্কৃতির সঙ্গে সমাজের যোগ আরও দূর পর্যন্ত শিকড় বিছিয়ে থাকে। এখন মফস্সলের পাড়ায় থাকে মন্দির, মসজিদ। শুধু ধর্মে নয়, সামাজিক মেলামেশাতেও থাকে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে গ্রামীণ সংস্কৃতির এই সমস্ত পুজো বা মেলা অনেক সহজ আর সরল।

বছর বছর সেই সহজ আচার বলে দেয়, পুরুলিয়ার গ্রামে গ্রামে সমাজ এখনও রয়েছে সারল্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন