বাড়ি ফেরার পথে খয়রাশোলে গুলি, কোপ তৃণমূলের ব্লক সভাপতিকে

হামলা হয়েছিল দু’বছর আগেও

সেই একই কায়দা। মোটরবাইকে চেপে আসা। বাগে পেয়ে ‘টার্গেট’কে গুলি। রবিবার দুপুরে এক অনুগামীর মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে হিংলো নদী পেরনোর পরে যে ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন খয়রাশোল ব্লক তৃণমূলের সভাপতি দীপক ঘোষ, তা অনেককে মনে পড়িয়ে দিয়েছে কয়েক বছর আগের জোড়া হত্যার কথা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

খয়রাশোল শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:৫৮
Share:

দীপক ঘোষ। ফাইল চিত্র।

সেই একই কায়দা। মোটরবাইকে চেপে আসা। বাগে পেয়ে ‘টার্গেট’কে গুলি। রবিবার দুপুরে এক অনুগামীর মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে হিংলো নদী পেরনোর পরে যে ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন খয়রাশোল ব্লক তৃণমূলের সভাপতি দীপক ঘোষ, তা অনেককে মনে পড়িয়ে দিয়েছে কয়েক বছর আগের জোড়া হত্যার কথা। মোটরবাইকে আসা আততায়ীরা দীপকবাবুকে লক্ষ্য করে প্রথমে গুলি চালায়। তিনি বাইক থেকে পড়ে গেলে পরপর ধারাল অস্ত্রের কোপ মারা হয়। ওই কায়দাতেই খুন করা হয়েছিল তৃণমূলের দুই প্রাক্তন ব্লক সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায় এবং অশোক ঘোষকে।

Advertisement

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একই ধরনের হামলা হয়েছিল দীপকবাবুর উপরে। যার পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশই বলছেন, খয়রাশোল রয়ে গিয়েছে খয়রাশোলেই!

এ দিনের হামলার দায় বিজেপি-র উপরে চাপিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। যদিও বিরোধাদের দাবি, শাসকদলের ব্লক সভপতির উপরে হামলার পিছনে রয়েছে তৃণমূলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রেশ। যা বহু চেষ্টা করে ধামাচাপা দিতে পারেননি জেলা নেতৃত্ব। ক্ষমতা দখলের লড়াইকে ঘিরে সেই দ্বন্দ্বই বারবার সামনে এসেছে বিস্ফোরণ, বোমাবাজি, খুন এবং নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে।

Advertisement

বিজেপি-র জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায়ের অভিযোগ, ‘‘আমাদের দিকে আঙুল না তুলে তৃণমূল নেতারা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথাটা স্বীকার করে নিন।’’

জেলা পুলিশের রেকর্ড বলছে, গত ৬ বছরে এলাকায় কমপক্ষে ৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দুই অশোক। বাকিরাও কেউ শাসকদলের নেতা বা কর্মী। গত তিন বছরে শুধু খয়রাশোলেই ৭টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কখনও নবনির্মিত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, কখনও বা তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়ি কিংবা দলীয় কর্যালয়, তৃণমূল নেতার ঘরের দেওয়াল বা গোয়ালঘরে সেই বিস্ফোরণ হয়েছে। তাতে প্রাণহানির সংখ্যা চার।

কেন এত হানাহানি খয়রাশোলে?

এলাকায় কান পাতলে শোনা যাবে, এর নেপথ্যে রয়েছে বিপুল কয়লা কারবার ও এলাকা দখলের লড়াই। অবৈধ ভাবে কয়লা উত্তোলন, পাচার, দু’টি খোলামুখ কয়লাখনির নিয়ন্ত্রণ— এই ‘সাম্রাজ্যের’ দখল কার হাতে থাকবে, দ্বন্দ্বের সূত্র সেখানেই।

বিরোধীদের অভিযোগ, কয়লা কারবারের রাশ হাতে রাখতে গেলে চাই রাজনৈতিক ক্ষমতা। তা নিয়েই নিত্য লড়াই চলে খয়রাশোলে। বিরোধীদের দাবি, ঠিকঠাক তদন্ত শেষ হলে বোঝা যাবে, রবিবার দীপকবাবুর উপরে হামলার পিছনে রয়েছে সেই দ্বন্দ্বের চোরাস্রোত।

তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে খয়রাশোলের কয়লা সাম্রাজ্যের দখল এবং গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির দখলকে ঘিরে দলীয় দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত আকার নেয়। ভোটের পরে তৃণমূলের দখলে আসা সিংহ ভাগ পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান কে প্রধান হবেন, তা নিয়েও বিবাদ দেখা দিয়েছি অশোক মুখোপাধ্যায় ও অশোক ঘোষ শিবিরের মধ্যে। ’১৩ সালের অগস্টে আততায়ীর গুলিতে হন অশোক ঘোষ। অভিযুক্ত ছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায় ও তাঁর অনুগামীরা। পরের বছর জুলাইয়ে একই ভাবে খুন হন অশোক মুখোপাধ্যায়ও।

তৃণমূলে সূত্রের খবর, দাদার মৃত্যুর পর থেকেই উত্থান দীপক ঘোষের। মাঝে অশোক মুখোপধ্যায়ের খুনের পরে কর্তৃত্ব কিছুটা খর্ব হলেও গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে ছবিটা বদলায়।

সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক নেতা খয়রাশোলের ব্লক সভাপতির দায়িত্ব থাকলেও মূলত দীপকবাবুর হাতেই ছিল প্রকৃত ক্ষমতা। এ বার পঞ্চায়েত ভোটের আগে ব্লক সভাপতি হওয়ার পরে এলাকার দীপকবাবু প্রভাব আরও বেড়েছিল। সেই সঙ্গে তাঁর শত্রুও বেড়েছিল বলে তাঁর অনুগামীদের ধারণা। দু’বছর আগের ডিসেম্বরে হামলার পরে প্রাণে বেঁচে ফেরেন দীপকবাবু। ওই ঘটনার পরে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সপরিবার খয়রাশোল সদরেই থাকেন। তার পরেও হামলা এড়াতে পারলেন না তিনি।

দুবরাজপুরের তৃণমূল বিধায়ক নরেশ বাউড়ি অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘ঘটনার খবর পেয়ে জেলা সভাপতির নির্দেশে ব্লক সভাপতি, অঞ্চল সভাপতিরা ছুটে গিয়েছেন দুর্গাপুরে। দীপকবাবু অত্যন্ত ভাল মানুষ। কাজের মানুষ। দলের একনিষ্ঠ কর্মী। গাড়ি থাকলেও তা ব্যবহার করেন না, বাইকে ঘোরেন।’’

তাঁর দাবি, দীপকবাবু খয়রাশোলের উন্নয়নে অনেক কাজ করছেন। সে জন্যই দুষ্কৃতীরা তাঁকে আক্রমণ করেছে। পুলিশ-প্রশাসন তদন্ত করে হামলাকারীদের গ্রেফতার করুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন