এই সারেই চাষ হচ্ছে আমনের।— নিজস্ব চিত্র
উঠোনে ঘেরা ছোট জায়গা। সেখানে দিন পনেরো আগে এক বিঘে জমির জন্য ৭০০ গ্রাম ধানের বীজ ফেলেছিলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য নিবেদিতা মণ্ডল, সুস্মিতা দাস, রাণু মণ্ডলরা। তার আগে বীজকে লবণ জল দিয়ে বাছাই ও গোমূত্র দিয়ে শোধণ করে নিয়েছিলেন তাঁরা। চারা বেরোতে সেই বীজ ধান তুলে চাষ শুরু করেছেন রামপুরহাটের বসুইপাড়ার জনার্দন মণ্ডল, নবকুমার মণ্ডল, অশোক মণ্ডলরা।
জৈব উপায়ে বীজধান তো হল। কিন্তু, কীটনাশকের অভাব কী করে পূরণ হবে, সারই বা কোথা থেকে আসবে?— তারও ব্যবস্থা দেখা গেল ওই উঠোনে। এক প্রান্তে দেখা গেল ধঞ্চে গাছের চারা লাগানো আছে। পাশেই তৈরি পাঁচ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম গুড়, ৫০০ গ্রাম ব্যসন, ১ লিটার গোমূত্র মিশিয়ে জৈব সার। দেখা গেল তা রোদে শোকানো হচ্ছে। তাতে কার্যকারিতা আরও বাড়বে বলে জানালেন ওই সদস্যেরা। চাপান সার হিসেবে ইউরিয়ার পরিবর্তে ওই জৈব সার ব্যবহার করা হবে।
আর ধঞ্চে কেন? নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং গাছের পাতা যাতে পাখি, পোকামাকড় খেতে না পারে তার জন্য ধঞ্চের চাষ— জানালেন গোষ্ঠীর সদস্যেরা। সেই সঙ্গেই চলছে কেঁচো সার, অ্যাজোলটা সার, নিম অস্ত্র, তরল সার এবং অন্য জৈব সারের উৎপাদন।
জৈব পদ্ধতিতে চাষের জন্য এ ভাবেই রামপুরহাট ১ ব্লকের আয়াস, বনহাট, কুশুম্বা এই তিনটি অঞ্চলের ৬৪টি স্বনির্ভর দলকে নিয়ে কাজ করে চলেছেন বীরভূম জেলা গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত দফতর। দুবরাজপুর, মহম্মদবাজার, বোলপুর–শ্রীনিকেতন ব্লককে জৈব পদ্ধতিতে চাষের জন্য নিবিড় ব্লক হিসাবে বাছা হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ জীবিকা মিশনের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করছে লোককল্যাণ পরিষদ।
রামপুরহাট ১ ব্লকের প্রকল্প আধিকারিক নীলোৎপল চৌধুরী বলেন, ‘‘ব্লকের স্বনির্ভর দলগুলিকে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে উপসঙ্ঘের মাধ্যমে পরিচালনা করে মহিলাদের আর্থিক সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে এই প্রকল্প।’’ এই প্রকল্পে উৎসাহ দিতে মহিলাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয় বলেও জানান নীলোৎপলবাবু। জেলা গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রামপুরহাট ১ ব্লকে তিনটি অঞ্চলের ৬৪টি স্বনির্ভর দলের ৩৫৮টি পরিবারকে নিয়ে এই প্রকল্প শুরু হয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের দ্বারা উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে ব্লকের বনহাট, কুশুম্বা, আয়াস অঞ্চলের ৫২.৫ বিঘা জমিতে শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষও শুরু হয়েছে। লোককল্যাণ পরিষদের পক্ষে যাদবকুমার মণ্ডল, তিলক মণ্ডলরা জানালেন, জুন মাসের ২০ ও ২১ তারিখে ওই তিনটি অঞ্চলে পঞ্চায়েত স্তরে বৈঠক করে কাজ শুরু হয়েছে।
আয়াস অঞ্চলের বসুইপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, জৈব পদ্ধতিতে চাষের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা উৎসাহ দিচ্ছেন। তাঁদের যুক্তি, নানা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছেন গোষ্ঠীগুলির মহাসঙ্ঘ সূর্যোদয় সঙ্ঘ। সঙ্ঘের কো-অর্ডিনেটর রেহেনা সুলতানা এবং গোষ্ঠীগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য সদস্য শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমী মণ্ডল, মমতাজ বেগমরা জানালেন অঞ্চলের বেলেবাড়ি ও বসুইপাড়া মিলে ১২২ টি পরিবার এখন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। কাজের গতিও ভাল বলে দাবি তাঁদের। সনাতন পদ্ধতিতে চাষ ছেড়ে জৈব চাষে আগ্রহ ফিরছে চাষিদের মধ্যেও। এ বার জনার্দন মণ্ডল, বিপদতারণ মণ্ডল, নবকুমার মণ্ডলরা চাষ জমির কিছুটা অংশে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করেছেন। সবমিলিয়ে এলাকার ২২ বিঘে জমিতে চাষ হচ্ছে। ভাল ফল মিললে ভবিষ্যতে আরও জমিতে চাষ করবেন বলে কথা দিলেন ওই কৃষিজীবীরা।
কৃষি দফতরের এক কর্তা অবশ্য জানাচ্ছেন, জৈব চাষে চাষ করলেই রাতারাতি জমির ফলন বেড়ে যাবে, এমনটা কিন্তু নয়। ফলন বাড়া অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল স্বাস্থ্যসম্মত চাষ। জমি ও উৎপাদিত ফসলের স্বাস্থ্য ভাল হলে সকলেরই লাভ। জৈব চাষে সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। তাতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিরও আর্থিক বুনিয়াদ শক্তিশালী হবে। কেমন? সদস্যদের কথায়, এখন উৎসাহ দিতে বিনামূল্যে জৈব সার দেওয়া হলেও পরে পয়সা নেওয়া হবে।
কৃষি দফতরের রামপুরহাট মহকুমার সহকারি কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) দিবানাথ মজুমদার মনে করেন, জৈব চাষই ভবিষ্যৎ। তিনি জানান, রাসায়নিক সারের প্রচুর ব্যবহারে জমির অম্ল ভাগ কমে যাচ্ছে। জমির জল ধারণ ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিকর দিকগুলিই তুলে ধরে জৈব চাষে উৎসাহিত দেওয়া হচ্ছে, জানাচ্ছেন দিবানাথবাবু।