বিষ্ণুপুরে ট্যাবলোর পাশেই নিয়ম ভাঙার যাত্রা। (ডানদিকে) পুরুলিয়ায় হেলমেট বিক্রি করছেন দুই নেপালি ভাই। ছবি: শুভ্র মিত্র ও সুজিত মাহাতো।
এত দিন হেলমেটের খরিদ্দার ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর একটি ঘোষণায় দুই জেলার শহরাঞ্চলের মোটর পার্টস বিক্রেতাদের পসরায় এখন রাশি রাশি হেলমেট। বৃহস্পতিবার সকালে পুরুলিয়া রাঁচি রোডের ধারে হেলমেট বিক্রি করছিলেন রমেশ ও নীতিশ পটেল। নেপালের বাসিন্দা এই দুই ভাই সারা ভারত ঘুরে হেলমেট বিক্রি করেন। সম্প্রতি তাঁদের এক জন ছিলেন মধ্যপ্রদেশে, এক জন ওড়িশায়। খবরের কাগজে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার কথা পড়ে দু’জনেই এসে ঘাঁটি গেড়েছেন পুরুলিয়ায়। জানালেন, যে ক’টা হেলমেট নিয়ে এসেছিলেন, সব শেষ। এখন আরও হেলমেটের বরাত পাঠিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই কোমর বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়েছেন পুরুলিয়ার পুলিশকর্মীরা। সাত সকালে বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন এলাকায় হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালাতে গিয়ে তাঁদের মুখোমুখি পড়লেই সটান জরিমানা। আবেদন-নিবেদন করতে গেলে বাস বা ট্রেন ফসকে যাচ্ছে, কিন্তু ছাড় মিলছে না।
এই কড়াকড়ির ফলও মিলছে হাতেনাতে। শহরের রাঁচি রোডের একটি মোটরবাইক শোরুমের মালিক রাজেশ শর্মা জানাচ্ছেন, এই ক’দিনে হেলমেট বিক্রি এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। আগে সারা দিনে সাকুল্যে চারটে হেলমেট বিক্রি হত। এখন বিক্রি হচ্ছে প্রায় চল্লিশটা। শহরের বি টি সরকার রোডের ব্যবসায়ী সতীশ দাস, রঘুনাথপুরের চন্দন নাগেদের মুখেও হাসি ফুটেছে। তাঁদের মন্তব্য, ‘‘এত দিন দোকানের হেলমেটগুলোতে ধুলো জমছিল। দুম করে পাঁচ-দশ গুণ বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন বোনাস পাচ্ছি।’’
‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’ নীতি নিয়ে পুরুলিয়ার মত কড়াকড়ি বাঁকুড়ায় শুরু হয়নি। তবে তার যে বেশি দেরি নেই, তা বিলক্ষণ টের পেয়েছেন মোটরবাইক চালকেরা। দোকানে দোকানে জমে উঠেছে ভিড়। বাঁকুড়ার লালবাজারে একটি মোটরপার্টসের দোকান রয়েছে বিশ্বজিৎ তিওয়ারির। তিনি জানান, কালে ভদ্রে একটা কী দুটো হেলমেট বিক্রি হতো। গত তিন দিনে বিক্রি হয়েছে কম করে দশটা। জেলার আর এক মহকুমা শহর বিষ্ণুপুরেও হেলমেটের বিক্রিবাটা জমে উঠেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রমরমিয়ে বিক্রি তো হচ্ছে। কিন্তু নিয়মের ফস্কা গেরোয় সুরক্ষা অধরা থেকে যাচ্ছে বলে দাবি করছেন খোদ বিক্রেতারাই। পুরুলিয়ার মোটরবাইক শোরুমের মালিক রাজেশবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করার অনেক কাল আগে, এক বার তাঁরা নিজেরাই ঠিক করেছিলেন, হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক বিক্রি করবেন না। এর ফলে সবাই হেলমেট কিনছিলেন বটে। কিন্তু সস্তার হাফ হেলমেট। যাকে সাধারণত টুপি হেলমেট বলা হয়। সেই হেলমেট মাথায় রাখলে আইন মানা হয়, কিন্তু দুর্ঘটনার সময় রক্ষা হয় না। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই ক্ষান্ত দিয়ে রাজেশবাবুরা ক্রেতাদের সুরক্ষার ভার তাঁদেরই উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মোটরবাইক কিনতে এলে শুধু বোঝানোর চেষ্টা করতেন, হেলমেট ব্যবহার করলে আদপে ক্রেতারই ভাল।
এ ক্ষেত্রেও হচ্ছে তাই। বাঁকুড়ার কাটজুড়িডাঙার একটি মোটরসাইকেল শো-রুমের কর্মী পল্লব খান জানান, তিন দিনে বিক্রি হয়েছে খান পনেরো হেলমেট। কিন্তু তার সিংহভাগই টুপি হেলমেট। বিষ্ণুপুরের যদুভট্টমঞ্চ সংলগ্ন একটি মোটরসাইকেল শোরুমের মালিক দেবব্রত নন্দী বা লালবাজারের ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎবাবুরা জানান, সবাই দোকানে এসে পাঁচশো টাকা দামের মধ্যে হেলমেট খুঁজছেন। তাঁরা জানান, ওই দামে যে হেলমেট মেলে তার গুণগত মানে অনেক ফাঁক থেকে যায়।
আইন মাফিক, হেলমেটে আইএসআই মার্কা থাকলে তবেই সেগুলি বৈধ হয়। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, ভাল মানের হেলমেটের দাম হয় কম করে ৭০০ টাকা। সেগুলি ফাইবারের তৈরি হয়। ভিতরে পুরু করে থার্মোকল দেওয়া থাকে। তাঁরা জানান, বাজারে আইএসআই মার্কাওয়ালা কমদামি হেলমেটেরও অভাব নেই। কিন্তু প্লাস্টিকের তৈরি সেই সমস্ত হেলমেট খুব একটা শক্তপোক্ত হয় না। অল্প আঘাতেই ভেঙে যায়। অধিকাংশ সস্তার হেলমেটে বাইরে আইএসআই মার্কা ছাপা থাকলেও, ভিতরে থাকে না। এ দিকে মাথায় ওই হেলমেট পরা থাকলে বাইরে থেকে কারও বোঝারও জো নেই।
সেই সুযোগ নিয়েই নিয়মের কড়াকড়িকে ফাঁকি দিচ্ছেন অনেক মোটরবাইক চালক। এ দিন দুই জেলার বেশ কিছু ক্রেতার স্বীকার করে নিয়েছেন, কমদামি হেলমেটে মাথা বাঁচানো যে যাবে না, তা তাঁরা নিজেরাও জানেন। তাহলে ঝুঁকি কেন নিচ্ছেন? মাঝবয়সি থেকে তরুণ বলেন, “শহরের মধ্যে বড় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম। তাই কম দামেই নিয়মরক্ষা করছি।’’
বাঁকুড়ার আরটিও সৌমেন দাস বলেন, “দুর্ঘটনা কাউকে বলে কয়ে আসে না। হাইরোডেও যেমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, শহরের মধ্যেও ঘটে যেতে পারে। মানুষকে বুঝতে হবে হেলমেটের প্রয়োজনীয়তা।’’ আরটিও দফতর হেলমেট কেনার আগে গুণগত মান যাচাই করে নেওয়ার জন্য ক্রেতাদের সচেতন করতে প্রচার করার কথা ভাবছে বলে তিনি জানান।
তবে সচেতনতা যতদিন গড়ে না উঠছে তত দিন তাঁরাও ছেড়ে কথা বলবেন না বলে সাফ জানাচ্ছেন পুরুলিয়ার পুলিশ কর্মীরা। তাতে ফলও মিলছে। যেমন, নিতুড়িয়ার রায়বাঁধের বাসিন্দা রঘুনাথ টুডু। এ দিন শহরের রাস্তায় পুলিশকর্মীদের মুখোমুখি পড়ে বার বার থমকে গিয়ে তিনি বলেই ফেললেন, ‘‘কাশীপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় তিন বার আটকেছে পুলিশ। আজকেই হেলমেট কিনে ফিরতে হবে দেখছি।’’