বাধা পেরিয়ে নায়ক ওরাই

সন্ত্রাসকে হারিয়ে জয়ী মাসুমরা

মাধ্যমিক, মাদ্রাসার পরে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলেও চমকে দিল জেলার রাজনৈতিক সন্ত্রাস কবলিত এলাকার পরীক্ষার্থীরা। সন্ত্রাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভাল ফল করে এলাকায় সাড়া ফেলে দিল নানুর-পাড়ুই-বোলপুরের ছেলেমেয়েরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নানুর ও বোলপুর শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০২:০৮
Share:

মাধ্যমিক, মাদ্রাসার পরে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলেও চমকে দিল জেলার রাজনৈতিক সন্ত্রাস কবলিত এলাকার পরীক্ষার্থীরা। সন্ত্রাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভাল ফল করে এলাকায় সাড়া ফেলে দিল নানুর-পাড়ুই-বোলপুরের ছেলেমেয়েরা। স্কুলে পাশের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই ৯৩ শতাংশ নম্বর পেয়েও চমকে দিয়েছে তারা।

Advertisement

অথচ বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে থেকেই এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে নানুরের বিদায়ী বিধায়ক গদাধর হাজরা এবং দাপুটে নেতা কাজল শেখের গোষ্ঠীর সংঘর্ষে বারবার তেতে উঠেছে নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের আওতায় থাকা বিভিন্ন গ্রাম। একই ভাবে ভুক্তভোগী হয়েছে বোলপুর বিধানসভা কেন্দ্রের পাড়ুই, ইলামবাজার ও বোলপুর থানা এলাকার একাধিক গ্রামও। কখনও বিজেপির সঙ্গে শাসকদল তৃণমূলের, আবার কোথাও তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের সঙ্ঘাত ছিল চরমে। দিনের পর দিন উভয় পক্ষের গোলাগুলির লড়াইয়ের কারণে বহু স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘদিন পড়তে যেতেই পারেনি। আবার আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বহু পরিবারের ছেলেমেয়েদের গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। আবার গ্রামে থেকেও অনেকে পড়াশোনা করতেই পারেনি। দরজা-জানলা এঁটে আলো নিভিয়ে কার্যত আত্মগোপনের দিন কাটাতে হয় তাদের।

এই পরিস্থিতিতে অনেক অভিভাবকই আশঙ্কা করেছিলেন, ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে খোদ পরীক্ষার্থীরাই। উচ্চ মাধ্যমিকে সিঙ্গি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৯৩ শতাংশ, বাহিরী ব্রজসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৯২ শতাংশ, হাঁসড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৮৯ শতাংশ ও পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠ থেকে ৬৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে ছাত্রছাত্রী পাশ করেছে। তার মধ্যে বাহিরীর গোলাম মাসুম ৪৪৭, সিঙ্গি হাইস্কুলের সচিন চক্রবর্তী ৪৪১ এবং পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠের সঙ্গীতা চক্রবর্তী ৪৫১ নম্বর পেয়ে স্কুলে প্রথম স্থান দখল করেছে। একই ঘটনা ঘটেছে নানুরের চারকল গ্রাম, বাসাপাড়া, ব্রাহ্মণখণ্ড প্রভৃতি স্কুলেও।

Advertisement

একই ভাবে মাধ্যমিকের স্কুলভিত্তিক ফলাফলেও বোলপুরের বাহিরী ব্রজ সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়, সিঙ্গি উচ্চ বিদ্যালয়, নাহিনা উচ্চ বিদ্যালয়, ইলামবাজার ও পাড়ুই থানা এলাকার একাধিক সন্ত্রাস কবলিত এলাকার স্কুলের পড়ুয়ারা ভাল ফল করেছিল। মাদ্রাসা পরীক্ষার ফলাফলেও একই ছবি ধরা পড়ে। সেই বাম আমল থেকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত নানুরের পাপুড়ি গ্রাম। ওই গ্রামেই কাজল শেখের বাড়ি। পাপুড়ি থেকেই গদাধর হাজরার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে টক্কর লড়েছেন কাজল। সেই গ্রামের হাইমাদ্রাসা থেকে এ বার রাজ্যে ৭১ নম্বরে জায়গা করেছিল মহসিনা খাতুন। শুধু তাই নয়, ওই মাদ্রাসারই ৩৯ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩১ জনই ভাল ভাবে পাশ করেছে।

ঘটনা হল, গত কয়েক মাস ধরে যে পরিস্থিতির মধ্যে দিন কেটেছে, তাতে পরীক্ষা দেওয়াটাই অনিশ্চিত ছিল ওই সব পড়ুয়াদের। তাদের কথায়, ‘‘আমাদের মনের মধ্যে অন্য রকম একটা জেদ কাজ করছিল। সেই জন্যই ভাল রেজাল্ট করতে পেরেছি।’’ পরীক্ষার্থীদের এমন সাফল্যে আনন্দিত অভিভাবকেরাও। হাঁসড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র প্রেমনাথ মণ্ডলের বাবা উজ্জ্বল মণ্ডল, বাহিরী ব্রজসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী বুদ্ধিন সরেনের বাবা সুনীল সরেন, পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠের ছাত্রী আমিনা খাতুনের বাবা ইরফান শেখরা বলছেন, ‘‘আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। সন্ত্রাস কবলিত এলাকার পরিস্থিতিও তথৈবচ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ছেলেমেয়েরা এই ফল করবে, ভাবতে পারিনি।’’

এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পরীক্ষার্থীদের এমন সাফল্যে আনন্দ লুকিয়ে রাখতে পারেননি সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা। হাঁসড়া স্কুলের অপূর্বকুমার চক্রবর্তী, সিঙ্গি উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বপনকুমার রায়, পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠের সীতারাম মণ্ডল এবং বাহিরী ব্রজসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রদীপ মণ্ডলরা বলছেন, ‘‘নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের এই সাফল্য বাকিদের উৎসাহ জোগাবে। এখনকার পড়ুয়ারা আরও ভাল ফল করবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন