দিদি শাবানার চোখের সামনেই বোন কুসুমকে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর স্বামী নজরুলের বিরুদ্ধে। বোনের মৃত্যুর পরে শোকার্ত দিদি। (উপর থেকে) নিহত কুসুম ও তাঁকে খুন করায় অভিযুক্ত নজরুল। ছবিগুলি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
মৃত্যু হল সিউড়িতে গুলিবিদ্ধ সেই কলেজ ছাত্রী কুসুম ওরফে টুনি খাতুনের। শুক্রবার সকালে দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরে সিউড়ি হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্তের পর কুসুমের দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বোনের উপর গুলি চালানোর ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই সিউড়ি থানায় নিজের স্বামী ও এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন দিদি শাবানা।
কী হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাতে?
ভর সন্ধেয় দিদি শাবানার সঙ্গে স্কুটিতে চড়ে বাড়ি ফেরার সময় প্রকাশ্য রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন সিউড়ির তিন নম্বর ওয়ার্ডের ফকিরপাড়ার বাসিন্দা টুনি। বাড়ি থেকে কয়েক শো মিটার দূরে সিউড়ি–সাঁইথিয়া বাইপাস রাস্তায় ডানদিকে থাকা চালকলের গলির সামনে ঘটনাটি ঘটে। নিহত ছাত্রীর পরিবারের দাবি, মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। সেই কারণে কুসুমকে নয় গুলি করে শাবানাকেই মারতে চেয়েছিল নজরুল। কিন্তু গুলি লাগে কুসুমের।’’
শুক্রবার শাবানা বিবি কাঁদতে কাঁদতে দাবি করেন, গত কাল সন্ধ্যায় স্থানীয় কাউন্সিলর বিদ্যাসাগর সাউয়ের সঙ্গে একটি বিষয়ে আলোচনা করে দুই বোনে বাড়ি ফিরছিলেন। বলেন, ‘‘আমিই চালাচ্ছিলাম স্কুটিটি। আমাদের বাড়ি আসার পথে সিউড়ি–সাঁইথিয়া বাইপাসটি এমনিতেই কিছুটা ফাঁকা থাকে। লোডশেডিং হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ-ই মনে হল, পিছনে একটি মোটরবাইক আসছে। বাইকটি কাছে আসতেই টায়ার ফেটে যাওয়ার মতো শব্দ পাই। বোনকে বলি, কিসের আওয়াজ দেখতে। কিন্তু বোন তখন ছিটকে পড়েছে স্কুটি থেকে। দেখি পিছনের বাইকটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার পিছনে আমার স্বামী, হাতে পিস্তল। বাইকটি অন্য জন চালাচ্ছে।’’
শাবানা জানান, তিনি ঘটনার পরপরই দেখেন তাঁর বোনের মাথা ফুঁড়ে দিয়েছে গুলি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। তিনি চিৎকার করেন, তাতে লোকজন ছুটে আসে। ঘটনার পরই সিউড়ি হাসপাতালে আশাঙ্কা জনকভাবে ভর্তি করানো হয় কুসুমকে। হাসপাতাল সুপার শোভন দে বলেন, ‘‘অস্ত্রপ্রচারও হয়। কিন্তু রাতের দিকে অবস্থার অবনতি হওয়ায় বর্ধমান মেডিকেল কলেজে রেফার করা হয়। কিন্তু জখম তরুনীর পরিজনেরা দূর্গাপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন।’’ দুর্গাপুরের হাসপাতাল জানিয়েছে, ভোর তিনটে নাগাদ যে পরিস্থিতিতে জখম ওই তরুণীকে আনা হয়েছিল, তখন তাঁর পরিজনদের জানানো হয় চিকিৎসায় সাড়া দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে সে নেই। এটা জানার পরই কুসুমকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসেন আত্মীয় স্বজনেরা। সকালেই মৃত্যু হয় তাঁর।
ছাত্রীর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সিউড়ির তিন নম্বর ওয়ার্ডের ফকিরপাড়ার বাসিন্দা আলাউদ্দিনের বড় মেয়ে শাবানার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রামপুরহাটের নজরুলের। অধিকাংশ সময় কার্যত শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকত নজরুল। আর সিউড়ি স্টেশন রোডের সামনে শ্বশুরের মনোহারি দোকান দেখাশোনা করত সে। গত এক বছর ধরেই মেয়ে জামাইয়ের মধ্যে নানা বিষয়ে বিবাদ শুরু হয় দু’জনের মধ্যে। একটি ধর্ষণের মামলায় মাস কয়েক জেল খেটে আসার পর স্বামী স্ত্রীর বিবাদ চরমে উঠে। কিছুতেই স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাইছিলেন না শাবানা।
কেন তাঁর স্বামী এমন করলেন? বছর ছাব্বিশের বধূ শাবানা বলেন, ‘‘এমনিতেই আমাকে হঠাৎ হঠাৎ মারধর করত স্বামী। কয়েকমাস আগে আমারই এক তুতো বোনের সঙ্গে ওই অন্যায়টা করেছিল। আমি সেটা মানতে পরাছিলাম না বলে চরম আশান্তি হত। গত কয়েক মাস আগে আমার বছর পাঁচেকের মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিল ও। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেয়েকে কাছে পাই। কয়েকজনকে ফোন করে জানিয়েছিল, গতকাল সে আসছে। কিন্তু সেটা যে খুন করার জন্য আমি ভাবিনি!’’
ঘটনা হল শাবানার দাবি, বহস্পতিবার রাতে শ্বশুর ফোন করে হুমকি দিয়েছেন তাঁকে। পুলিশের কাছে শ্বশুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের না করলেও মৌখিকভাবে সেটা জানিয়েছেন তিনি। অভিযোগ পেয়েও অভিযুক্তকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। তবে ছেলের গতিবিধি জানতে রামপুরহাটের রেল আবাসন থেকে নজরুলের বাবা রেলপুলিশের কর্মী নুর মহম্মদ মিনা ও শাশুড়িকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।