অবহেলায় এমনই হাল সরকারি শৌচালয়ের। —নিজস্ব চিত্র।
দৃশ্য ১: রবিবার সকালের জমজমাট টিনবাজার। ‘‘দাদা এখানে কোনও টয়লেট রয়েছে? খুব তাড়া আছে!”— সামনে থাকা সব্জি বিক্রেতাকে কাতর প্রশ্ন এক প্রৌঢ়ের। গন্তব্যটা দেখিয়ে দিয়ে সেই বিক্রেতা বিপদে পড়া প্রৌঢ়কে বললেন, ‘‘ওই যে পাশে গলি। সোজা চলে যান। দেওয়ালে লেখা ‘প্রস্রাব করিবেন না’। ‘না’টা অবশ্য কাটা আছে। ওখানেই নিশ্চিন্তে কাজটা সারুন।’’
দৃশ্য ২: সন্ধে গড়িয়ে একটু রাত। সিউড়ি-সাঁইথিয়া রুটের বাস এসে দাঁড়িয়েছে ইন্দিরা চকের মোড়ে (মসজিদ মোড়ে)। বাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে নামছেন দুই মহিলা। “দাদা বাথরুমটা কোথায় একটু বলবেন প্লিজ।”— তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তরে মাথা চুলকোতে শুরু করলেন খাবার হোটেলের মালিক নির্মল খুরমা। একটু ভেবে নিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, ‘‘কাছেপিঠে বলতে আদালত চত্বরে একটা ছিল। রাতে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আপনারা বরং বাসট্যান্ড চলে যান।”
জেলা সদর সিউড়ি। তারই দু’টি জ্বলজ্যান্ত ছবি এটি। এই শহরে যে কাউকে জিজ্ঞেস করে যতটা সহজে শৌচকর্মের স্থানটা খুঁজে নিতে পারেন এক জন পথচলতি পুরুষ, ঠিক ততটাই কঠিন নয় কি মহিলাদের ক্ষেত্রে? বিপদের মুখেও ক’জন মহিলা রাস্তাঘাটের মানুষের কাছে এই প্রশ্নটা করতে পারবেন। আর পারলেও পথেঘাটে প্রয়োজনে মহিলাদের শৌচকর্ম সারার কোনও স্থানের সন্ধান কি দিতে পারবেন? বড় অংশের সিউড়িবাসীর উত্তর— না। প্রশ্ন উঠছে, গ্রামে গ্রামে ‘নির্মল বাংলা’ বা ‘নির্মল বীরভূম’ গড়ার যখন ধুম উঠেছে, তখন শহরগুলিই অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে না? অন্তত জেলা সদরের হাল দেখে আশানুরূপ উত্তর মিলছে না।
সদাইপুরের পাচতেঁতুলে গ্রাম থেকে রোজ সিউড়িতে ক্লাস করতে আসেন বিদ্যাসাগর কলেজের ইংরেজির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সৌমি মণ্ডল। তাঁরই মতো মহম্মদবাজারের শেওড়াকুড়ি থেকে সিউড়ির বীরভূম মহাবিদ্যালয়ে ক্লাস করেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফাহমিদা সুলতানা। তাঁরা জানাচ্ছেন, আসা-যাওয়ার পথে শৌচাগার থাকার বিশেষ প্রয়োজন। না থাকায় মাঝে মধ্যেই তাঁদের খুব অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। দুই তরুণীরই খেদ, ‘‘সমাজে যে মেয়েরাও রয়েছেন, তাঁদেরও এমন অনেক কিছুরই সমান প্রয়োজন রয়েছে— আমাদের সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষের মাথায় সেই ভাবনাটারই তো কোনও অস্তিত্ব নেই!’’
ঘটনা হল, বাসস্ট্যান্ড, হাসপাতাল, আদালত চত্বর (রবিবার ও ছুটির দিন তা-ও বন্ধ) বাদ দিলে জেলা সদরে মহিলাদের জন্য কোনও সাধারণ শৌচাগার নেই। যে দু’একটি ছিল, তা দীর্ঘ দিন আগেই কার্যত পরিত্যক্ত হয়েছে। সরকারি বা ব্যক্তিগত কাজে জেলা সদরে আসা মহিলারা শৌচকর্মের জন্য তা হলে কোথায় যাবেন? অথচ পুলিশ লাইন, এসপি মোড়, টিন বাজার, ইন্দিরা চক, রবীন্দ্রপল্লি— এই সব জনবহুল এলাকায় শৌচালয়ের বিশেষ প্রয়োজনের কথা স্বীকার করেন শহরের প্রায় সব মানুষই।
অবশ্য শুধু বাইরে থেকে আসা মহিলারই যে এ ক্ষেত্রে অপদস্ত হন, তা কিন্তু নয়। কমবেশি একই রকম দুর্ভোগে পড়েন স্থানীয়রাও। ইন্দিরা চকে এক জুতোর দোকানের মালিক অর্পণা দাস, কনফেকশনারি দোকান চালান রাবিয়া বেগম কিংবা দীর্ঘ দিন ধরে ওই এলাকাতেই অস্থায়ী কাপড়ের দোকানি মামনি দাস— হঠাৎ করে এমন অসুবিধায় পড়লে তাঁরা কিী করেন? কেউ লজ্জার মাথা খেয়ে বাড়িতে ফোন করে অন্যের হাতে দোকান তুলে দিয়ে ঘরে চলে যেতে বাধ্য হন। কাউকেবা দোকানটাই সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখতে হয়। দুপুর থেকে রাত শহরের ডাকঘর মোড়ে একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ চালান আলো দে। একই রকম সমস্যায় ভোগেন তিনিও। তাঁর কথায়, “আমার দোকানের কাছেই আদালতের শৌচাগার আছে। তাই সাময়িক ভাবে অসুবিধা হয় না। তবে সন্ধের পরে বা ছুটির দিনে তা বন্ধ থাকলেই চিন্তা হয়। অনেক সময়ই বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হই।’’
বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মেনেছেন সিউড়ির পুরপ্রধান উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। উজ্জ্বলবাবু বলেন, “শহরে স্থানাভাবের জন্য ইচ্ছা থাকলেও প্রয়োজন মতো শৌচাগার করা যাচ্ছে না। পুরসভায় একটা পুরানো শৌচাগার আবার চালু হবে। সিউড়ির বাজার আর এসপির মোড়ের ১নং পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় নতুন দুটি শৌচাগার তৈরি হয়েছে তবে এখনও চালু হয়নি।”
অন্য দিকে, মহকুমাশাসক হিসেবে এক জন মহিলাকে পেয়েছেন শহরবাসী। সেই অরুন্ধতী ভৌমিক বলছেন, ‘‘সমস্যাটা বাস্তব। জেলায় এই বিষয়ে আলোচনা চলছে। পুরসভার সহযোগিতায় কোন কোন এলাকায় শৌচাগার গড়া যায়, দেখা হবে।’’ প্রশাসন এবং পুরসভা অন্তত মেয়েদের জন্য একটি উন্নতমানের শৌচালয় গড়ে শহরের লজ্জা ঢাকুক। এমনটাই আর্জি অপর্ণা, রাবিয়াদের।