স্নেহ: ছাত্রদের মাঝে। নিজস্ব চিত্র।
অবসর নিয়েছেন বছর দশেক। কিন্তু পড়ুয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না তিনি। তাই অবসরের পরেও টানা দশ বছর বিনা পারিশ্রমিকে ছাত্রদের পড়ানোয় তিনি ক্লান্তিহীন। বয়স কোনও ভাবেই ছায়া ফেলতে পারেনি কাশীপুরের সোনাথলি-কালাপাথর হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক দ্বিজপদ সূত্রধরের রুটিনে।
সেই ১৯৬৭-র জুলাইতে এই স্কুলে তাঁর আসা। কিন্তু কী ভাবে তারপরে চল্লিশটা বছর কেটে গিয়েছে, কখন এই গঞ্জের ছেলেমেয়েগুলো, স্কুলের কলরব তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, বুঝতে পেরেছিলেন অবসরের সময়ে। দ্বিজপদবাবুর কথায়, ‘‘ছাত্রেরা আমায় ভালবাসে। আমিও ওদের ছেড়ে থাকব, এটা কোনওদিন ভাবতে পারিনি। তাই অবসরের পরেও আর আমার বাড়ি ফেরা হল না।’’
বাঁকুড়া সদর থানার কেঞ্জাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা দ্বিজপদবাবু এই স্কুলে এসেছিলেন কাঠের মিস্ত্রি হিসেবে। স্কুলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অমরনাথ পান্ডে জানান, তখন স্কুল সবে শুরু হয়েছে। কাঠের প্রচুর কাজের জন্য দ্বিজপদবাবুকে আনা হয়েছিল। কিন্তু পরে দ্বিজপদবাবুর শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক কর্মশিক্ষার শিক্ষক হিসেবে তাঁর নাম সুপারিশ করেন। ‘ক্রাফট টিচার’ হিসেবে তিনি স্কুলে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন।
দ্বিজপদবাবুর কথায়, ‘‘প্রথমে স্কুল উন্নয়ন তহবিল থেকে আমাকে পঞ্চাশ টাকা বেতন দেওয়া হতো। গ্রাম থেকে স্কুলে আসার অনেক সমস্যা থাকায় থাকতাম স্কুল চত্বরেই।’’ এখানে থেকেই তিনি স্নাতকের পড়াশোনাও করেন। স্কুলের এক সহ-শিক্ষক নিমাইকৃষ্ণ মাহাতোর কথায়, ‘‘দীর্ঘদিন ধরেই উনি ছাত্রাবাসে থাকেন। লেখাপড়ার দেখাশোনা ছাড়াও কাকভোরে উঠে ছাত্রদের নিয়ে বাগানের পরিচর্যা, শরীর চর্চায় উৎসাহ দেন। দশম শ্রেণির দীনেশ রায়, নবম শ্রেণির বিশ্বনাথ বাউরি, পঞ্চম শ্রেণির সুকুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘স্যার আমাদের গাছ চেনান। কোন গাছের কী উপকারিতা তা জানান। স্কুল চত্বরের আগাছা পরিষ্কার রাখা কেন দরকার, তাও তিনিই শিখিয়েছেন।’’
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, ‘‘অবসরের পরে বাড়ি ফিরে যেতে হবে শুনে উনি প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলেন। চোখ ছলছল করে উঠেছিল। নিজেই জানিয়েছিলেন এই স্কুল, ছাত্রদের ছেড়ে চলে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অবসরের পরে আজও বিনা পারিশ্রমিকে তিনি নিয়মিত ছাত্রদের পড়িয়ে যাচ্ছেন।’’
স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই স্কুল তাঁর রক্তের সঙ্গে যেন মিশে গিয়েছে। উনি নিজেকে স্কুলের থেকে আলাদা ভাবতে পারেন না।’’
সাত মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাই এখন বাড়িতে একাই থাকেন দ্বিজপদবাবুর স্ত্রী ঝর্নাদেবী। মাসে এক-দু’বার তিনি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেন। তবুও অবসরের পরে স্বামীর স্কুলে থেকে যাওয়ায় কোনও আক্ষেপ বা অভিযোগ নেই তাঁর। বলেন, ‘‘আসলে মানুষটা স্কুল আর ছাত্র ছাড়া গোটা জীবনে কিছুই বুঝল না। তাই অবসরের পরে খুব আনন্দ করে বলেছিল, ‘জানো আমি স্কুলে থেকেই পড়াব’। আমরা আর কেউই আপত্তি করিনি। বুঝেছিলাম বাধা দিলে ভেঙে পড়বে। ওঁর আনন্দেই তো আমাদের আনন্দ।’’