স্কুলকে খেলার মাঠ উপহার শিক্ষকদের

সবই ছিল স্কুলে। ছিল না কেবল একটি খেলার মাঠ। এ বার তা-ও পেল দুবরাজপুরের কুখুটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। সৌজন্যে— ওই স্কুলেরই শিক্ষকেরা। তাঁদের চেষ্টায় স্কুলে এখন ৭ বিঘার বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:১৪
Share:

নিজেদের মাঠে পড়ুয়াদের শরীরচর্চা। —নিজস্ব চিত্র।

সবই ছিল স্কুলে। ছিল না কেবল একটি খেলার মাঠ। এ বার তা-ও পেল দুবরাজপুরের কুখুটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। সৌজন্যে— ওই স্কুলেরই শিক্ষকেরা। তাঁদের চেষ্টায় স্কুলে এখন ৭ বিঘার বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ।

Advertisement

প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ভালবাসা থাকলে কত দূর করা যায়— তার অন্যতম নিদর্শন ওই স্কুলের শিক্ষকেরা। স্কুলে আসা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের খরচ বাঁচিয়ে এবং নিজেরা সাধ্যমতো খরচ করে স্কুল ঘেঁষা মাঠটা কচিকাঁচাদের উপহার দিয়েছেন ওঁরা। খেলার ওই জমিটির সিংহভাগ ইতিমধ্যেই রেজিস্ট্রি ও রেকর্ড হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতির নামে। সামান্য অংশের রেকর্ড হওয়া শুধু বাকি।

বছর ১৬ আগেও ভগ্নপ্রায় একটি ক্লাসঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল ১৯৪৬ সালে স্থাপিত ওই স্কুল। কিন্তু খোলনলচেই বদলে গিয়ে এখন ওই স্কুল দ্বিতল। প্রি প্রাইমারি-চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসের জন্য ঝকঝকে পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ। ক্লাসঘরে আলো, পাখা। মিড-ডে মিল রান্নার জায়গা। আছে পার্ক, দোলনা। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য টাইলস বসানো পৃথক শৌচাগার। কম্পিউটার, খেলার সরঞ্জাম। শিক্ষামূলক ভ্রমণ থেকে পিকনিক— সবেতেই এগিয়ে স্কুল।

Advertisement

“স্কুলের এমন উন্নতির জন্য যদি সরকারি অর্থ সাহায্য একটি দিক হয়ে থাকে, বাকিটা শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও পড়ুয়াদের জন্য কিছু করার চেষ্টা,”—বলছেন অভিভাবকেরা। অভিভাবক আশুতোষ ভাণ্ডারি, সঞ্জীব রুজ, মামণি দাঁ-রা বলছেন, ‘‘শিক্ষকেরা পড়ুয়াদের জন্য যা করেছেন, তা প্রকাশের ভাষা নেই। একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে যে এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব, ভাবতে পারছি না।’’

স্কুল সূত্রের খবর, স্কুলকে কীভাবে পড়ুয়াদের ভাল লাগার জায়গা হিসাবে গড়ে দেওয়া যাঁয়— এটা প্রথম যাঁর মাথায় আসে, তিনি রামতনু নায়ক। ২০০০ সালে সহ-শিক্ষক পদে যোগ দেওয়ার পরে রামতনুবাবুই বাকি শিক্ষকদের মধ্যে তাঁর ভাবনা সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। সঙ্গী ছিলেন আর এক সহ-শিক্ষক, আঁকায় পারদর্শী উদয় পাল। বর্তমানে উদয়বাবু স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।

এমনিতে স্কুলকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা শুরু হয়েছিল আগেই। তবে ২০০৬ সালে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হওয়া শুরু। স্কুল সূত্রের খবর, স্কুলের মোট চার শিক্ষক নিজেরা পকেট থেকেই পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে স্কুল চত্বরে গড়ে দেন পার্ক। এর পর খরচ বাঁচিয়ে ধাপে ধাপে কখনও সাব-মার্সিবল পাম্প বসিয়ে পানীয় জলের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে ক্লাসঘরে আলো, পাখা লাগানোর কাজও হতে থাকে। শুধু পরিকাঠামো গড়াই নয়, পড়াশোনা থেকে মিড-ডে মিলের পদ— সবেতেই সমান যত্নবান শিক্ষকেরা। জাতীয় কল্যাণ সংস্থা থেকে ২০০৯ সালে এবং ২০১৪ সালে নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার পেয়েছে দুবরাজপুরের ওই স্কুল।

অসুবিধা ছিল পড়ুয়াদের মাঠ না থাকাটা। রামতনুবাবু, উদয়বাবুরা বলছেন, ‘‘শতাধিক পড়ুয়া। এতগুলো কচিকাঁচা খেলবে কোথায়? তাই ২০১০ সালে মাঠ গড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। সবাই মিলে চেষ্টাটা শুরু করি।’’ ধাপে ধাপে প্রায় ৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সাত বিঘা জমি কেনা হয়েছে। জমির মালিক ও তাঁদের শরিকদের বোঝানো, দরদাম করা থেকে জমি কেনা, রেকর্ড করা— সবটাই নিজেরা করেছেন ওঁরা। এমন উদ্যোগে পড়ুয়া, অভিভাবকেরা তো বটেই, খুশি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি রাজা ঘোষও। তিনি বলছেন, ‘‘অত্যন্ত ভাল উদ্যোগ। আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন ওঁরা।’’

বর্তমানে স্কুলে ১৯৮ জন পড়ুয়া। স্কুলটা তাদের খুব প্রিয়, বলছে পড়ুয়া রহিমা, সাবিরা, হিমাদ্রি, বিশ্বজিৎ, পায়েলরা। স্কুলের প্রতি টান বজায় রেখে এখন নিয়মিত স্কুলে আসেন তিন বছর আগে প্রধান শিক্ষিকার পদ থেকে অবসর নেওয়া অর্চনা রুজও।

তবে সমস্যা এখনও আছে। শিক্ষকেরা বলছেন, ‘‘মূলত দু’টি সমস্যা। কেনা মাঠটিকে উন্নত করে ঘিরে নেওয়া এখন বাকি। দ্বিতীয় সমস্যা হল, স্কুলে রাতে কিছু মদ্যপ ঢুকে অত্যাচার চালায়। যে কারণে স্কুলের বেশ কিছু সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে।’’ গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আবেদনপত্র পাঠিয়ে মদ্যপদের আটকানোর কথা ভাবছেন শিক্ষকেরা। কিন্তু খেলার মাঠ ঘেরার টাকা কই? রাজাবাবু বলছেন, ‘‘ওঁরা পঞ্চায়েত সমিতিকে অবেদন করতে পারেন। আমাকে জানালে জেলা প্রশাসনকে মাঠটিকে ঘিরে দেওয়ার আবেদন করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন