সুনসান: গাছগাছালি ঘেরা রাস্তায় যাতায়াত। শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লিতে। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
অবসরযাপনের অন্যতম ঠিকানা শান্তিনিকেতন। কখনও চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার পরে, কিংবা শুধুই ছুটির দিনগুলো কাটাতে অনেকেই চলে আসেন এখানে। তাঁরা বাড়ি বানিয়েছেন বা কিনেছেন এখানে। সপরিবার কিংবা নিঃসঙ্গ শান্তির দিন কাটে শান্তিনিকেতনে। শান্তির খোঁজেই। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা মানসিক ভাবে অশান্ত করে তুলেছে তাঁদের বড় অংশকে।
কেন?
তাঁরা জানাচ্ছেন, শান্তিনিকেতন ও সংলগ্ন এলাকায় ফাঁকা বাড়িতে চুরির ঘটনা একাধিক বার ঘটেছে। এমনকি বাড়িতে বৃদ্ধাকে একা পেয়ে গলায় ছুরি ঠেকিয়ে ছিনতাইও হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, নিঃসঙ্গ জীবন, একাকি অবসরযাপন— এই সবই কি নিশানা হয়ে উঠছে দুষ্কৃতীদের কাছে! কারণ, প্রবীণদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এমনিতেই কম।
শান্তিনিকেতনে অশান্তির সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগেই হয়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারির রাতে শান্তিনিকেতনের বাগানপাড়ায় নিজের বাড়ির দোতলার ঘরে খুন হন কলকাতার একটি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা রেণু সরকার (৭৮)। লোহার রড দিয়ে ওই বৃদ্ধার নাকে আঘাত করা হয়েছিল। ওই খুনের ঘটনায় নিহতের বাড়ির কেয়ারটেকার এবং এলাকার দাগি দুষ্কৃতী মঙ্গল সাহানি ও তার শাগরেদ পিন্টু দাস গ্রেফতার হয়। ওই ঘটনা নিয়ে তখন বিস্তর হইচই হলেও সময়ের সঙ্গে তা স্তিমিত হয়।
এখন আবার আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি সামনে আসছে। এবং তা আসছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার সূত্র ধরেই। আর তাতেই ভয়ে রয়েছেন শান্তিনিকেতনের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। সন্ধ্যা বলেই নয়, দিনেও খুব পরিচিত ছাড়া কাউকে ঘরের ভিতরে ঢুকতে দিতে সাহস পান না তাঁরা। তাঁদের কথায়, অচেনা লোক যে কী মতলব নিয়ে আসবে, জানব কী করে! তাই কার্যত গৃহবন্দি অনেকেই। এই ভয় তাঁদের এসেছে দুর্গাপুজোর কিছুদিন আগে শান্তিনিকেতনের দিগন্তপল্লিতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার পর থেকে। কলকাতার বাসিন্দা, ৭৯ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা হৈমন্তী দত্তগুপ্তের পৈতৃক বাড়ি শান্তিনিকেতনেই। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি দিগন্ত পল্লির একটি বাড়ি পেয়েছিলেন। কখনও একা, কখনও বোনকে নিয়ে থাকতেন। সে বার একাই এসেছিলেন।
৫ অক্টোবর সন্ধ্যা নামার আগেই এক যুবক দুর্গাপুজোর চাঁদা তোলার কথা বলে ওই বৃদ্ধার বাড়িতে ঢোকে। অভিযোগ, তাঁর গলায় একটি ছুরি বৃদ্ধার ঠেকিয়ে আলমারি থেকে নগদ টাকা, হাতের সোনার বালা, মোবাইল ছিনতাই করে পালায় দুষ্কৃতী। যাওয়ার আগে হৈমন্তীদেবীকে বাথরুমে বন্ধ করে রেখে যায়। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই অমর্ত্য সেনের মামাতো বোন কাজরী রায়চৌধুরীর গুরুপল্লির বাড়িতে চুরি হয়। তখন অবশ্য বাড়িতে কেউ ছিলেন না। তাঁর ছেলে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘হৈমন্তীদেবীর মতো আমার মা যদি বাড়িতে একা থাকতেন, একই ঘটনা ঘটতে পারত। চাহিদা মতো জিনিস না পেলে আরও খারাপ কিছু হতে পারত।’’
শান্তিনিকেতনের মানুষ মনে করছেন, বাড়িতে বয়স্ক মানুষের একা থাকা এবং কেউ না থাকা—দু’টোরই সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা।
এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি একই দিনে চোর সন্দেহে বোলপুরের লায়েকবাজারে গণপিটুনি দেওয়া হয় দুই যুবককে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার এই প্রবণতাও ক্রমবর্ধমান। নাগরিকেরা তাই মনে করছেন, বোলপুর-শান্তিনিকেতনে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। আর তাই সাধারণ মানু. নানা ক্ষেত্রে ধৈর্য হারাচ্ছেন। অপরাধ বাড়ায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন প্রবীণেরা। বিশ্বভারতীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সুনীল মাঝি প্রায় ৯০ বছরের দোরগোড়ায়। ছেলে-পুত্রবধূর কর্মসূত্রে আসা-যাওয়া। প্রায়ই তিনি একা থাকেন। বললেন, ‘‘এই সব ঘটনা সত্যিই ভাবিয়ে তুলছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’’ বিশ্বভারতীর আর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মী তারকেশ্বর মিশ্রের কথায়, ‘‘মেয়ের শারীরিক অসুস্থতার জন্য মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী বাইরে থাকেন। আমাকে প্রায়ই একা থাকতে হয়। এখানে নিরাপত্তা বলে কিছুই নেই।’’
এই অবস্থায় এক দিকে যেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার দাবি উঠেছে, অন্য দিকে, পুলিশের আর্জি, যে কোনও সমস্যাতেই যেন নির্দ্বিধায় বয়স্কেরা পুলিশকে জানান। বয়স্কদের নিরাপত্তায় সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে জেলা পুলিশ।