বীজের ‘শক্তি’ ভাঁজুই উৎসবে চেনে বড়গোগা

প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হারিয়েছে প্রাসঙ্গিকতা। কিন্তু লাভপুরের বড়গোগা গ্রামের ভাঁজো উৎসব আজও গুরুত্ব হারায়নি। বংশপরম্পরায় গ্রামের মহিলারা ওই উৎসবে মেতে ওঠেন। 

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

লাভপুর শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২৯
Share:

উৎসবমুখর: ভাজুইয়ে মেতেছেন গ্রামবাসী। বড়গোগায়। নিজস্ব চিত্র

প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হারিয়েছে প্রাসঙ্গিকতা। কিন্তু লাভপুরের বড়গোগা গ্রামের ভাঁজো উৎসব আজও গুরুত্ব হারায়নি। বংশপরম্পরায় গ্রামের মহিলারা ওই উৎসবে মেতে ওঠেন।

Advertisement

লোকমুখে প্রচলিত, মূলত বিভিন্ন শস্যবীজের মান পরীক্ষার জন্য গ্রামবাংলায় এক সময় ভাঁজো বা ভাজুই উৎসবের সূচনা হয়। গ্রামবাসীদের একাংশের বক্তব্য, বর্তমানে বীজ সংরক্ষণ, সংশোধন ও সর্বোপরি কৃষিতে এসেছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। ধারাবাহিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্র দখল করেছে উন্নত প্রজাতির উচ্চফলনশীল বীজ। সেই হিসেবে ওই উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা আজ আর নেই। তবু আজও মহাসমারোহে ভাঁজো ব্রত বা উৎসবে মেতে ওঠেন মহিলারা। শুক্রবারই শুরু হল সেই উৎসব। টানা ১০ দিন চলবে ব্রতপালন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মেয়েরাই ওই ব্রত পালন করে থাকে। শস্য কামনায় ওই ব্রত করা হয় বলে ভাজুইকে ‘শসপাতার ব্রত’ও বলা হয়। ‘শস’ অর্থে শস্য আর ‘পাতা’ অর্থে বিছানো। পাত্রে শস্য বিছিয়ে অঙ্কুরোদ্গম ঘটানোই ওই ব্রতের উদ্দেশ্য।

Advertisement

সাধারণত ভাদ্র মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে ‘ইন্দধ্বজ’ উৎসব বা ইন্দপুজোর পরের দিন হয় ভাজু ব্রতের সূচনা। সেই হিসেবে ইন্দপুজোর পরিবর্তনের সঙ্গে ভাজুব্রতেরও সময়কালের হেরফের হয়। সাধারণত ছোট মেয়েরাই ওই ব্রত পালন করে থাকে। তবে কোথাও কোথাও বিবাহিত মেয়েদের মধ্যেও ওই ব্রত পালনের চল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের ব্রত ‘বড়ো ভাজুই’ আর বাচ্চাদের ব্রত ‘ছোট ভাজুই’ হিসেবে পরিচিত হয়। বড়গোগা গ্রামে সব বয়সের মহিলারাই ব্রত পালন করেন।

গ্রামবাসীরা জানান, মনে করা হয় ব্রত পালনের মাধ্যমে ওই ভাবেই পরীক্ষা করে নেওয়া হয় বীজের অঙ্কুরোদ্গম ঘটানোর শক্তি। ভাদ্রের পরেই রবি মরসুম। রবিচাষে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ শস্যবীজ দিয়েই ভাজুই পাতা হয়। যার ভাজুই পাত্রের শস্যের অঙ্কুরোদ্গম ভাল হয় তাদের পরিবারে বয়ে যায় খুশির হাওয়া। কারণ তাঁদের বাড়িতে সংরক্ষিত শস্যের বীজ ভাল বলে গণ্য হয়। সেই বীজ তখন অন্যেরাও নিয়ে চাষ করেন। সে ক্ষেত্রে ফসলের উৎপাদন কমার আশঙ্কা থাকে না। এ জন্য পরিবারের বড়রাও নিয়মিত অঙ্করোগদমের খোঁজখবর নেন। উৎসাহ দেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ভাজুই ব্রত পালনের পরিস্থিতিও বদলেছে। অধিকাংশ জায়গায় এখন তালপাতার ঘরের বদলে কোনও মন্দির বা ক্লাবে ভাজুই পাতার চল হয়েছে। তালের খোঙ্গো বা নারকেল মালার বদলে এসেছে মাটির ভাঁড়। কোথাও কোথাও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মহিলারাও অংশ নেন। তবে ব্রত পালনের ধারা আজও প্রায় একই রকম রয়ে গিয়েছে সেই গ্রামে।

এ দিন মনসাতলা থেকে শোভাযাত্রা করে মাটি এনে ক্লাবঘরে ভাঁজো বা ভাজুই পেতেছেন ওই গ্রামের ১৩ জন গৃহবধু। তাঁদেরই অন্যতম রিনা দাস, কালী দাস, মায়া দাস, উন্নতি দাস বলেন, ‘‘১৫-২০ বছর আগে বিয়ে হয়েছে আমাদের। আগে বাপের বাড়িতে ভাঁজো পাততাম। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে পাতি।’’

উজ্বল দাস, সন্তোষ দাস বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই মা-ঠাকুমাদের ভাঁজো পাততে দেখছি। তাঁদের মুখেও শুনেছি— ‘ভাজু লো সুন্দরী, মাটি লো সরা। কাল ভাজুইয়ের বিয়ে দেব পঞ্চফুলের মালা। পঞ্চফুল থগা থগা গলায় গেঁথেছি। কাউকে যেন বলো না ভাজুই পেতেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন