তামাকমুক্ত গ্রাম, দিশা দেখাচ্ছে ছোড়া-বড়ঘাটা

প্লাস্টিকমুক্ত গ্রাম তৈরির নজিরের পর এ বার তামাক-বর্জিত গ্রাম! এমনই দৃষ্টান্ত স্থাপনের লক্ষ্য নিয়েছে সেই খয়রাশোল ব্লকেরই দু’টি গ্রাম। আজ, সোমবার সেই গ্রাম গড়ার শপথ নিতে চলেছেন ছোড়া ও বড়ঘাটা নামে ওই দুই গ্রামের মানুষ।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৬ ০১:০৯
Share:

শপথ নেওয়ার প্রস্তুতি গ্রামের দেওয়ালে। —নিজস্ব চিত্র

প্লাস্টিকমুক্ত গ্রাম তৈরির নজিরের পর এ বার তামাক-বর্জিত গ্রাম!

Advertisement

এমনই দৃষ্টান্ত স্থাপনের লক্ষ্য নিয়েছে সেই খয়রাশোল ব্লকেরই দু’টি গ্রাম। আজ, সোমবার সেই গ্রাম গড়ার শপথ নিতে চলেছেন ছোড়া ও বড়ঘাটা নামে ওই দুই গ্রামের মানুষ।

কেন তামাক সেবন উচিত নয়, কেন ধূমপান করা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক— সেগুলি বোঝাতে গত একমাস ধরে বাড়ি বাড়ি প্রচার, দেওয়াল লিখন চলেছে দুই গ্রামে। সেই প্রস্তুতি-পর্ব সে দিনই পেতে চলছে চূড়ান্ত রূপ। জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলছেন, ‘‘গ্রামের সকলের উপকার হবে, সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এমন উদ্যোগ কোনও গ্রাম নিলে বাকিদের কাছেও তা দৃষ্টান্ত। যেমনটা হয়েছে একই ব্লকের প্লাস্টিকমুক্ত গ্রাম কদমডাঙার ক্ষেত্রে। এখন অনেক গ্রামই তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছে।’’

Advertisement

ঘটনা হল, পাহাড় অঞ্চল বাদ দিয়ে সমতলে এমন উদ্যোগ প্রায় বিরল। যেখানে প্রশাসনিক নজরদারি এবং জরিমানা করে ‘স্মোক-ফ্রি জোন’ তৈরি করতে হয়। অনেকেই নাগাল্যান্ডের পাহাড়ি গ্রাম গাড়িফেমাকে দেশের প্রথম তামাক-বর্জিত গ্রাম বলে চিহ্নিত করেন। আবার ২০১৫ সালে কেরলের পানামারামকে তামাক-বর্জিত গ্রাম করতে উদ্যোগ নিয়েছিল ইন্ডিয়ান ওয়েল। সে দিক থেকে দেখতে গেলে সমতলের এমন প্রত্যন্ত গ্রামে এই ধরনের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে বলেই মনে করছেন পরিবেশবিদেরা। বিশিষ্ট পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘ধূমপান শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। তাই জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু, তা মানে ক’জন? শহরের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষও পাত্তা দেন না। সেখানে প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক মানুষেরা এই যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা একটা নতুন দিশা দেখাবে।’’

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, খয়রাশোল ব্লকের যে পঞ্চায়েতগুলি ইতিমধ্যেই ‘নির্মল’ বলে ঘোষিত, সেই তালিকায় রয়েছে রূপসপুর পঞ্চায়েতও। ছোড়া-বড়ঘাটা ওই পঞ্চায়েতেরই দু’টি গ্রাম। ‘স্বচ্ছভারত’ বা ‘নির্মল বাংলা’র লক্ষ্যে শুধু শৌচাগার গড়া আর তা ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করুন— ব্লক প্রশাসনের কর্তাদের এমন ‘ভোকাল টনিক’ কোথাও যেন তাতিয়ে দিয়েছিল ছোড়া ও বড়ঘাটা গ্রামের বেশ কিছু মানুষকে। খয়রাশোলের বিডিও তারকনাথ চন্দ্র এবং যুগ্ম বিডিও অভিষেক মিশ্র বলছেন, ‘‘সেই ভাবনা থেকেই গ্রামের মানুষ তমাকমুক্ত গ্রাম গড়ার পরিকল্পনা নেন। যেটা বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা খুব খুশি।’’

গ্রামের মানুষরা জানাচ্ছেন, ধূমপান যে শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক, তা সকলেই জানেন। কিন্তু একবার নেশা ধরলে সেটা ছেড়ে দেওয়া বেশ শক্ত। গ্রামের যুবক বিলাস দাস, উজ্জ্বল ঘোষদের কথায়, ‘‘নেশা ছাড়ার জন্য ঘরে-বাইরে চাপ থাকে, ছাড়তেই হবে নেশা। যদি দোকান থেকেও নেশার দ্রব্য না মেলে, তখন সেটা বন্ধ না করে উপায় নেই। তাই ঠিক এই জায়গাটাই আঘাত করা শুরু হয়েছে প্রথমেই।’’ স্থানীয় বাসিন্দা অমিয় ঘোষ, রামকৃষ্ণ সূত্রধরেরা জানান, তাঁদের মতো যাঁরা ধূমপান করেন না, প্রথমে তাঁরাই এগিয়ে এসে প্রচার শুরু করেন। প্রচারে সাড়া দিয়ে যাঁরা আগে ধূপমান করতেন, তাঁরাও নেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘এর পরে নজরদারি করার জন্য মহিলা পুরুষ ও পড়ুয়াদের দিয়ে দল গঠিত হয়েছে। দলের সদস্য সংখ্যা প্রায় জনা পঞ্চাশ। তামাক, সিগারেট, বিড়ি প্রকাশ্যে বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়েছে গ্রামের মুদিখানা ও পান-সিগারেটের অন্তত বারোটি দোকানকে।’’ কেউ যাতে ঘরের ভিচরেও সিগারেট বিড়ি বা তামাক সেবন না করেন, তা-ও নজরে রাখছেন মহিলা ও ছেলেমেয়েরা।

গ্রামবাসীদের মতে, এমন উদ্যোগে একসঙ্গে তিনটি উপকার হবে। এক, তামাক সেবন জনিত রোগ কমবে। দুই, খরচ কমবে। আর তিন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এমন একটা উদাহরণ তৈরি হবে, যাতে তারাও বড় হয়ে নেশা থেকে বিরত থাকে। পরিবারে বড়দের সিগারেট খাওয়া বন্ধ করতে বলছে পড়ুয়ারাও। মিনু মণ্ডল, পল্লবী মণ্ডল, লক্ষ্মীকান্ত গড়াই, সমাপ্তি ঘোষরা বলছে, ‘‘যে নেশা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক, তা কেন আপনজনেরা খাবে? তাই সকলের ভালর জন্যই বাধা দিচ্ছি।’’ সেই চেষ্টার ফল হিসেবে ইতিমধ্যেই প্রায় পরিবারেরই লুকিয়ে চুরিয়ে তামাকসেবনও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করছেন দুই গ্রামের লোরজনই। গ্রামের বধূ মাধুরী দাস, ক্ষমা দাসরা বলছেন, ‘‘অনেক বার স্বামীদের বারণ করেছি। শোনেনি। কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই শুনছে। গোটা গ্রাম যেখানে এককাট্টা, তখন আর সিগারেট বিড়ি খাবে কী করে!’’

শপথ নেওয়া সহজ। সেটা পালন করাই যে শক্ত, সে কথা জানে দুই গ্রাম। বাসিন্দারা তাই বলছেন, ‘‘আমরা সব সময়ই সতর্ক থাকব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement