শেষ দিন। সোমবার নানুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর সেবায় ব্যস্ত সুধাদেবী। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
বছর পনেরো আগের এক গভীর রাত। চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রসব যন্ত্রণায় কাতর স্ত্রী। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না নানুরের ব্রাহ্মণপাড়ার নিখিল সাহা। অত রাতে কোনও রকমে স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে তাঁর মাথায় হাত— ডাক্তার নেই। এ দিকে, স্ত্রীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। স্ত্রীকে দূরে কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও নেওয়া যাচ্ছে না। বিপদের এই মুহূর্তেই মুশকিল আসান করে কার্যত ঈশ্বরের মতো নিখিলবাবুর স্ত্রীকে বুকে টেনে নিলেন এক নার্স। নিজের কোয়ার্টারেই নির্বিঘ্নে প্রসব করালেন ওই অন্তঃসত্ত্বা মহিলার।
উপরের ঘটনাটিই একমাত্র উদাহরণ নয়। সবার প্রিয় ওই নার্সের কর্মজীবনে এমন অনেক ঘটনার কথাই মনে পড়ে নানুরবাসীর। এ ভাবেই সেই নার্স সুধা বিশ্বাস বরাট-ই হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘সুধাদি’। সেবা-শুশ্রুষায় শুধু রোগী কিংবা তাঁদের পরিজনদেরই নন, হয়ে উঠেছেন সহকর্মী থেকে চিকিৎসকদেরও আপনজন। বার কয়েক মাথার ছাদ বদলালেও কর্মস্থলের সূচনা লগ্ন থেকে তিনি ছিলেন একই ছাদের তলায়। আজ, মঙ্গলবার ৩৭ বছরের সেই নিরবচ্ছিন্ন বন্ধন ছিন্ন করে নানুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছেড়ে চলে যাবেন সুধাদি। এমন এক প্রিয় মানুষের অবসরের খবরে তাই মনখারাপ নানুরবাসীর।
১৯৭৯ সালে গড়ে ওঠে নানুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সে দিন থেকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই নার্স হিসেবে কাজ করেছেন সুধাদি। অন্যত্র বদলির ফরমান অবশ্য বার কয়েক এসেছে। কিন্তু, প্রতি বারই ‘যেতে নাহি দিব’র দাবি তুলেছেন বাসিন্দারা। চাপে পড়ে সেই বদলি প্রত্যাহার করতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে খোদ প্রাক্তন বিধায়ক প্রয়াত আনন্দ দাসকেও। বর্তমানে বোলপুরে সুধাদির ছোট্ট সংসার। স্বামী তরুণগোপাল বিশ্বাস একটি রাসায়নিক সার সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্তা। বছর তিনেক আগে মেয়ে শ্রীপর্ণার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে শ্রীজিৎ পেশায় বিজ্ঞানী। লখনৌতে কর্মরত। ছেলে বারবার স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে মাকে বিশ্রাম নিতে বলেছেন। কিন্তু, সে কথা কানেই তোলেননি সুধাদি। ভালোবাসার টান আটকে রেখেছে তাঁকে। আজ আর অবশ্য তাঁকে আটকে রাখা যাবে না, জেনে গিয়েছেন সবাই।
সেই সুধাদির কথা তুলতেই কান্নায় কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলেন না ব্রাহ্মণপাড়ার নিখিল সাহা, নতুনপাড়ার মহসিন শেখরা। দুর্দিনে দু’জনেরই স্ত্রীর প্রসব করিয়েছিলেন তিনি। তাঁরা বলছেন, ‘‘সে দিন সুধাদি দায়িত্ব না নিলে হয় স্ত্রী কিংবা সন্তানকে হারাতে হতো আমাদের।’’ শুধু নিখিলবাবুরাই নন, এলাকার অধিকাংশ প্রসূতি-সহ অন্যান্য রোগীদের ক্ষেত্রে সুধাদি একই ভাবে এগিয়ে এসেছেন। পরিজনদের বারবার একই প্রশ্নে কখনও বিরক্ত হতে দেখা যায়নি তাঁকে। বরং সাহস জুগিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন। দুঃস্থদের ওষুধ-পথ্যেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কখনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে, কখনও বা নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে। স্থানীয় রামকৃষ্ণ সেবা বিদ্যাপীঠ নামে কচিকাঁচাদের একটি স্কুলের সম্পাদক সমীর করের কথায়, ‘‘স্কুলের ৪০০ ছেলেমেয়ের অধিকাংশই সুধাদির কাছে ঋণী। কেউ জন্মের পরে প্রথম কোল পেয়েছে সুধাদির। কেউবা রোগ যন্ত্রণায় কপালে পেয়েছে স্নেহের স্পর্শ।’’ সেই সুধাদির জন্যই আজ প্রতিষ্ঠানে বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন তাঁরা।
একই আয়োজন করেছে নানুর ব্লক স্বাস্থ্য দফতরও। এলাকার স্বাস্থ্য-চিত্রে সুধাদির অবদানের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন নার্স শাশ্বতী মণ্ডল, বিভা মুখোপাধ্যায়, স্বাস্থ্যকর্মী বসুমতি মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় থেকে খোদ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ও। তাঁরা বলছেন, ‘‘উন্নততর পরিবেশে বদলির সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও টানা ৩৭ বছর একই জায়াগায় কাটিয়ে দেওয়াটা বিরল দৃষ্টান্ত। সুধাদি কখনই নিজেকে তাঁর কাজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। বরং রোগীর এবং পরিজনদের জন্য নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত বহু সমস্যায় ওঁর অভিজ্ঞতা আমাদের সমাধানের পথ দেখিয়েছে। ওঁর অভাব এখন থেকে পদে পদে অনুভব করব।’’ একই অভিব্যক্তি সুধাদিরও। তাঁর কথায়, ‘‘পরিবারের সঙ্গে থাকলেও মনটা সব সময় এখানেই পড়ে থাকবে। জীবনের বেশির ভাগ সময়টা তো এখানেই কাটালাম।’’
সেই কবে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’— মানবতার বাণী শুনিয়েছিলেন চণ্ডীদাস। সেই বাণী কার্যত মিথ্যেই হতে বসেছিল সন্ত্রাসদীর্ণ নানুরে। ক্ষমতা করায়ত্ত করার জন্য বিরোধী-শাসক তো বটেই, গোষ্ঠী সংঘর্ষে মানুষের জীবনকে বাজি রাখার ঘটনা হামেশাই ঘটেছে। এমন একটি এলাকায় টানা ৩৭ বছর ধরে মানুষের জীবন বাঁচানোর ব্রত পালন করে সবাইকে একসূত্রে বেঁধেছেন সুধাদি। তাই এলাকার বর্তমান সিপিএম বিধায়ক শ্যামলী প্রধান থেকে প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা, দু’জনেই একসুরে বলছেন, ‘‘নানুরের জন্য সুধাদির অবদান কোনও দিনই ভোলার নয়। ওঁর মতো মানুষের পদাঙ্ক সমাজের সর্বত্র সত্যিই অনুসরণযোগ্য।’’