মেসে ফাইফরমাস খেটে স্নাতকোত্তরে প্রথম

নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত সংসারে। তাই ফটিককে বড় হতে হয়েছে পরের জিম্মায়, অন্যের ফাইফরমাস খেটে। ফটিকের গলায় সোনার পদক ওঠার পর বাবা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখের জল বাঁধ মানতে চায়নি।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৯ ০৪:২৬
Share:

কৃতী: বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুজিত মাহাতো

নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত সংসারে। তাই ফটিককে বড় হতে হয়েছে পরের জিম্মায়, অন্যের ফাইফরমাস খেটে। ফটিকের গলায় সোনার পদক ওঠার পর বাবা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখের জল বাঁধ মানতে চায়নি। সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে পদক পেয়েছে ফটিক। অভাবকে নিত্যসঙ্গি করে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর স্তরে এবার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে শিক্ষাজগতের বিশিষ্টজনেদের সামনে তাঁর গলায় পদক উঠেছে সোনার পদক।

Advertisement

ফটিকের ভাল নাম বিশ্বজিৎ। বাড়ি পুরুলিয়া শহরের নিমটাঁড় এলাকায়। বাবা কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। সামান্য আয়ে সংসার চলে না। ফটিকের জন্মের পরই তাঁকে বন্ধু নিতাই মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রদীপবাবু। একটি মেসে পাচকের কাজ করতেন বচন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাঁকে ‘বড়বাবা’ বলে ডাকতেন ফটিক। বড়বাবা রান্না করতেন। আর ফটিক মেসের আবাসিকদের ফাইপরমাস খাটতেন। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মেসেরই এক চিলতে ঘরে বড়বাবার কাছে গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ত একচিলতে ফটিক।

ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে ঝাপসা হয়ে উঠেছিল ফটিকের দু’চোখ। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্ঘটনায় একটা পা হারিয়েছিলেন বাবা। আমার তখন জ্ঞানও হয়নি। বাবা আমাকে মেসে তাঁরই পরিচিত একজনের কাছে রেখেছিলেন ওই মেসবাড়িই ছিল আমার ঘরদোর।’’ তাঁর বাবার মন্তব্য, ‘‘আমি ওর জন্য তেমন কিছু করতে পারিনি। যেটুকু পেরেছি করেছি। কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করেছে আমার ছেলে।’’

Advertisement

ফটিকের ছোটবেলা ছিল তাঁর বন্ধুদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফটিকের ভাষায়, ‘‘ওরা যখন খেলতে যেত, তখন আমাকে ফাইফরমাস খাটতে হত। তবে এর জন্য কোনও আক্ষেপ ছিল না। কারণ ‘বড়বাবা’ দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন।’’

বড়বাবার মৃত্যুর পর ফটিকের মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও চলে গিয়েছিল। ফিরে আসতে হয় বাবা-মায়ের কাছে। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘বাবা কাপড়ের দোকানের কর্মী। মা অন্যের বাড়িতে পাচকের কাজ করতেন।’’ অনেকেই তখন ফটিককে ‘কোন একটা কাজে’ ঢুকে পড়তে বলেছিলেন। কিন্তু লেখাপড়া করে পরিবারের দুঃখ কাটানোকেই চ্যালেঞ্জ বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি।

অভাবের সঙ্গে লড়াই করেই মানভূম ভিক্টোরিয়া ইন্সষ্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন ফটিক। তারপর ওই স্কুল থেকেই উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে শীর্ষস্থান দখল করেন। স্নাতকস্তরে পড়াশোনার জন্য ইতিহাসই কেই বিষয় হিসাবে বেছে নেন। ফটিক বলেন, ‘‘কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়ে বাতিঘর নামে একটি সংস্থা আমাকে খুবই সহায়তা করেছে। পরবর্তীকালেও একাধিক শিক্ষক আমাকে সহায়তা করেছেন।’’

পুরুলিয়া জগন্নাথ কিশোর কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক হন ফটিক। ততদিনে পুরুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। ফটিকের কথায়, ‘‘স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে গেলাম ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু খরচ কে যোগাবে জানতাম না। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো শুরু করলাম। আমাদের একটাই ঘর, রান্নাবান্না-খাওয়া-শোওয়া— সবই সেই ঘরেই হয়। অসুবিধা হওয়ায় টিউশন বন্ধ করতে হয়েছিল।’’

জলাভাবের পুরুলিয়ায় অনেকেই জল কেনেন। ফটিক বাড়িবাড়ি জল দেওয়ার কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িবাড়ি টাইম কলের জল পৌঁছে দিয়ে দু’টো পয়সা পেতাম। সেই অর্থে পড়াশোনা চালিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় শিক্ষকেরাও সহায়তা করেছেন। বিশেষত যিনি বিভাগীয় প্রধানের সাহায্য ভোলার নয়।’’

নিমটাঁড়ের বাসিন্দা শ্যামল মাহাতোর কথায়, ‘‘আমার বাড়িতে ও অনেকদিন ধরেই জল দিয়েছিল ফটিক।’’ এলাকারই আরেক বাসিন্দা অমিত সেন বলেন, ‘‘ফটিক আমার বাড়িতে এখনও জল দেয়। খুবই কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ভর্তির পরে ফটিক একদিন তাঁর অসুবিধের কথা জানিয়েছিল। প্রয়োজনে সাহায্য করব বলে কথা দিয়েছিলাম। অভাব থাকলেও খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে ফটিক। স্নাতকোত্তরে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করে সফল হয়েছে।’’

সাঁওতালডিহি কলেজে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজের একটা সুযোগ পেয়েছেন ফটিক। প্রাচীন পুরুলিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।

লড়াইয়ের পরের ধাপে পৌঁছেছেন ফটিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন