অসুখ, অনটন পেরিয়ে মেজিয়ার আলো সমীর

মায়ের দু’টি পা সংক্রমণের জেরে বাদ গিয়েছে। তাই পঙ্গু মা এবং ঘরকন্না দু’টিই এখন তার কাঁধে। বাবার দিনমজুরির ক’টা টাকাতেও আবার সংসার চলে না। তাই পরিবারের পেট ভরতে কখনও ১০০ দিনের কাজ, কখনও খেতমজুরিও তাকে করতে হয়েছে।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

মেজিয়া শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৪ ০০:৪৯
Share:

মায়ের সঙ্গে সমীর গড়াই। ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

মায়ের দু’টি পা সংক্রমণের জেরে বাদ গিয়েছে। তাই পঙ্গু মা এবং ঘরকন্না দু’টিই এখন তার কাঁধে। বাবার দিনমজুরির ক’টা টাকাতেও আবার সংসার চলে না। তাই পরিবারের পেট ভরতে কখনও ১০০ দিনের কাজ, কখনও খেতমজুরিও তাকে করতে হয়েছে। এত অন্ধকার পেরিয়ে মেজিয়ার আলো হয়ে উঠেছে জপমালি দেশবন্ধু হাইস্কুলের ছাত্র সমীর গরাই। উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪৩৩ নম্বর পেয়ে স্কুলে প্রথম হয়েছে। সমীরের এই লড়াইটা কিন্তু এত সহজ ছিল না।

Advertisement

জপমালি গ্রামের সমীর নিতান্ত অভাবের সংসারে দুই দিদির সঙ্গে মানুষ হয়েছে। গ্রামে গিয়ে দেখা গেল বিদ্যুত্‌হীন একটি টালির চালা দেওয়া মাটির বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে সমীর। তার বাবা কার্তিক গরাই জানান, বছর ছ’য়েক আগে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে বাড়ি তৈরির জন্য বরাদ্দের অর্ধেক টাকা পঞ্চায়েত থেকে হাতে পেয়েছিলেন। সেই টাকায় কোনও মতে বাড়িটি খাড়া করেছিলেন তিনি। তবে, আর্থিক অনটনের জেরে বিদ্যুত্‌ সংযোগ নেওয়া যায়নি। দিনমজুরি করে তাঁর যা আয় হয়, তার পুরোটাই সংসারের ব্যয়ে খরচ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এত দিন স্কুলের শিক্ষক, কিছু সহৃদয় ব্যক্তির সৌজন্যে ছোট ছেলেকে টেনেটুনে পড়াশোনা করিয়েছেন। তবে, সম্প্রতি সমীরের বাবাও ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। দিদিদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পঙ্গু মায়ের সেবা থেকে রান্নাবান্না, ঘরে ঝাড়ু লাগানো সব দায়িত্বই সামলেছে সমীর। দিনমজুরি করে সংসারে টাকার জোগান দেওয়াও শুরু করেছে। তার জন্য স্কুলেও অনিয়মিত ভাবে যেতে পেরেছে। এমনকী, ভোর আর রাত মিলিয়ে কেরোসিনের বাতি জ্বেলে যা ঘণ্টাখানেক পড়তে পেয়েছে। তাতেই এ বারের উচ্চ মাধ্যমিকে তার প্রাপ্ত নম্বর বাংলায় ৮৪, ইংরেজিতে ৭৭, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৮৭, ইতিহাসে ৯৩ ও ভূগোলে ৯২। হঠাত্‌ করে উচ্চ মাধ্যমিকেই উন্নতি করেনি সমীর। মাধ্যমিকেও সে ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক তপন কেশ জানান, সমীর খুব অভাবি ঘরের ছেলে। কিন্তু দারুন মেধাবী। তাঁর কথায়, “স্কুল থেকে যতটা পেরেছি, পড়ার বই-নোটস্‌ দিয়ে ওকে সাহায্য করেছি।” গ্রামেরই আরও তিন শিক্ষক তাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন। বিনিময়ে কোনও টাকা নেননি সেই ধনঞ্জয় কুণ্ডু, চণ্ডীচরণ কুণ্ডু এবং রাজেশ কর্মকার। রাজেশবাবু বলেন, “একের পর এক সমস্যার মুখে দাঁড়িয়েও সমীর হাল ছাড়েনি। এই ধরনের কঠিন মানসিকতার ছেলে সাধারণত দেখা যায় না। ও জীবনে অনেক উন্নতি করবে।” কিন্তু এত দূর পর্যন্ত আসতে পারলেও আর্থিক সমস্যা সমীরের উচ্চ শিক্ষায় বাধা হয়ে উঠবে না তো? বাবার পাশাপাশি তার শিক্ষকদেরও সেই একই চিন্তা। যদিও রাজেশবাবুরা জানিয়েছেন, যত দূর পারবেন, ওই মেধাবি ছাত্রের পাশে দাঁড়াবেন।

Advertisement

সমীরের অবশ্য ক্ষোভ, দফতরে দফতরে বহু ঘুরেও সমীর তার প্রতিবন্ধী মায়ের ভাতা পায়নি। এ দিকে, ছেলে ভাল রেজাল্ট করেছে, কিন্তু তার পড়াশোনার খরচ জোগানো যে কোনও ভাবেই সম্ভব হয়ে উঠছে না, আক্ষেপের সঙ্গে জানিয়েছেন কার্তিকবাবু। বরং অভাবের সংসারে সমীরের খেত মজুরির কাজের উপরেই তিনি ভরসা করছেন। সমীরের মা চায়নাদেবী বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য, ছেলেকে আমরা আর পড়াতে পারব না।” সমীর নিজে জানাচ্ছে, গত এক বছরে সে মেরেকেটে ১৫ দিন ১০০ দিনের কাজ পেয়েছে। “খেতে দিনমজুরির কাজ পরীক্ষার আগে থেকে বন্ধ রেখেছিলাম। পেট চালাতে এ বার পুরোদমে শুরু করতে হবে,” বলছে ওই মেধাবী ছাত্র।

যদিও সমীরের পড়শি শম্ভু ধীবর জানিয়েছেন, সমীর গ্রামের গর্ব। তাঁদের সামর্থ্য কম হলেও প্রত্যেক গ্রামবাসীই সমীরের পাশে দাঁড়াবেন। আবার গত রবিবারই জপমালির সেরা পড়ুয়ার সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন শালতোড়ার তৃণমূল বিধায়ক স্বপন বাউরি। তিনি বলেন, “সমীরের সমস্ত দায়িত্ব নিচ্ছি। প্রশাসনিক ও দলীয় ভাবে আমরা ওর পড়াশোনার খরচ জোগাব।” ইংরেজি তার প্রিয় বিষয়। ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্নের কাছাকাছি কতটা পৌঁছনো যাবে, তা নিয়েই চিন্তায় এই অভাবি ছাত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন