ময়ূরেশ্বর

ইতিহাসের রাজসাক্ষী ময়ূরেশ্বর

এক জনপদ। বহু জনশ্রুতি। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁওয়া লাগে সেই শ্রুতিতে। কান পাতলেই শোনা যায় ঐতিহাসিক সংলাপ। পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের নানা কথা ও কাহিনির সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন এই জনপদের নাম ময়ূরেশ্বর। জনপদের নাম কেন ময়ূরেশ্বর? এক সময় ময়ূরেশ্বর পরিচিতি ছিল কোট মৌড়েশ্বর হিসাবে। সে অবশ্য অনেক কাল আগের কথা। তখন প্রাচীর আর পরিখা বেষ্টিত ছিল জনপদটি।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৪১
Share:

কুণ্ডলতলার মন্দির। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

এক জনপদ। বহু জনশ্রুতি।

Advertisement

হাত বাড়ালেই যেন ছোঁওয়া লাগে সেই শ্রুতিতে। কান পাতলেই শোনা যায় ঐতিহাসিক সংলাপ। পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের নানা কথা ও কাহিনির সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন এই জনপদের নাম ময়ূরেশ্বর।

জনপদের নাম কেন ময়ূরেশ্বর?

Advertisement

এক সময় ময়ূরেশ্বর পরিচিতি ছিল কোট মৌড়েশ্বর হিসাবে। সে অবশ্য অনেক কাল আগের কথা। তখন প্রাচীর আর পরিখা বেষ্টিত ছিল জনপদটি। জেলার প্রাচীন যে সমীক্ষা রয়েছে, তাতে দৌড়ি-মৌড়েশ্বর পরগণার উল্লেখ রয়েছে। সেই পরগণারই অন্যতম নগর আজকের ময়ূরেশ্বর। অতীতে এখানে মুন্সেফ কোট চালু ছিল বলে মনে করেন আঞ্চলিক ঐতিহাসিকরা। জেলার ইতিহাসে মেলে, এই এলাকার রাজা মুকুটেশ্বর রায়ের কথা। তাঁরই নাম থেকে ক্রমবর্ণবিবর্তনে ময়ূরেশ্বরের জন্ম।

গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, শ্রীচৈতন্য ভাগবতে উল্লেখিত গ্রাম দেবতা মৌড়েশ্বর শিবের নামানুসারে এলাকার এই নাম। ঘটনা হল, মুকুটেশ্বর ছাড়াও ইতিহাস-আশ্রিত অনেকের নাম জড়িয়ে রয়েছে ময়ূরেশ্বর নামের সঙ্গে। তেমনই একজন বাজ বসন্ত। এই রাজারও নাকি রাজত্ব ছিল ময়ূরেশ্বর।

বাংলার ইতিহাসের নানা চরিত্র ও ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে এমনভাবেই ময়ূরেশ্বরের সঙ্গে। বাংলার বারো ভুঁইয়া’র অন্যতম কেদার রায়ের নামটি যেমন। তাঁরও কর্মক্ষেত্র ছিল এই জনপদ। কেদার রায় রোড নামে এলাকার একটি রাস্তা তার সাক্ষ্য বহন করছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

রাজা নয়ন পালের রন্ধনশালার অধ্যক্ষ চক্রপাণি দত্ত জন্মেছিলেন এখানেই। এই ময়ূরেশ্বরে নাকি, নীলাচলে যাওয়ার পথে নিত্যানন্দের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নিমাই পণ্ডিতের। নিত্যানন্দের মামার বাড়ি ছিল এখানেই।

এক সময় কবি নজরুলও পা রেখেছিলেন ময়ূরেশ্বরে। আত্মীয়তার সুবাদে কিংবা ইংরেজ আমলের নজর বন্দি হিসাবে তিনি এসেছিলেন বলে প্রচলিত অনুমান। বিদ্রোহী কবি এখানে বসেই ১৩২৬ সালে লিখেছিলেন ‘পরীর কথা’। ‘নুর’ পত্রিকার ফাল্গুন-চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাটির রচনাস্থান ‘ময়ূরেশ্বর’ বলে উল্লেখিত।

এখানকার কুণ্ডলতলাকে কেন্দ্র করেই জড়িয়ে রয়েছে মহাভারতের একটি কাহিনিও। জনপদ ঢোকার মুখেই পড়ে কুণ্ডলতলা। লাগোয়া বীরচন্দ্রপুর থেকে কোটাসুর পর্যন্ত এলাকা মহাভারতের একচক্রাধাম হিসাবে পরিচিত। কথিত রয়েছে, অজ্ঞাতবাসের সময় কুন্তী-সহ পাণ্ডবরা আশ্রয় নেয় লাগোয়া বীরচন্দ্রপুরে। মহাভারতের এক অ্যাখানে মেলে, অর্জুনের ছোঁড়া সর্পবাণে একবার বিষধর সাপের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে ওঠেন নগরবাসীরা। তাঁরা গিয়ে ধরেন নিত্যানন্দকে। নিত্যানন্দ কানের কুণ্ডল দিয়ে ঢেকে দেন সর্পকূলকে। সেই জায়গাটিতেই গড়ে ওঠেছে মন্দির। যা পরে কুণ্ডলতলা হিসাবে খ্যাত।

সঈদ পীরের আস্তানা।

কুণ্ডলতলার মতো দেবী পলাশবাসিনী, ফলহারিণী কালি, ময়ূরেশ্বর শিব, মহাপ্রভু তলা, ধর্মরাজ তলা ঘিরেও প্রচলিত রয়েছে নানা কথা ও কাহিনি। যেমন রয়েছে কালা সঈদ পীরের আস্তানাটি ঘিরে। সম্প্রীতির মেল বন্ধন ঘটিয়ে এখানে মিলিত হন সব সম্প্রদায়ের মানুষই। পাতে পাত ঠেকিয়ে এখানে পঙক্তিভোজে বসেন ধর্মমত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ।

এলাকার সাহিত্যকর্মী বিমল সোম, শিক্ষাকর্মী রাজকুমার ফুলমালি বলেন, “ময়ূরেশ্বরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নানা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। রয়েছে কুণ্ডলতলা, কালা সঈদ পীরের আস্তানার মতো স্থান। পর্যটনের সম্ভাবনা তো আছেই, এলাকার একটি সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখিত হওয়া দরকার।”

ময়ূরেশ্বর ২ - এর বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান বলেন, “ময়ূরেশ্বরের লিখিত ইতিহাস নানা গ্রন্থে ছড়িয়ে রয়েছে। একটি সম্পূর্ণ রূপ থাকা দরকার। তবে পর্যটনের বিষয়টি নিয়ে এলাকার মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। ভাবনায় আছে, প্রস্তাব এলে শীর্ষ মহলে সে নিয়ে কথা বলব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন