তৈরি হচ্ছে মোরব্বা। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
সিউড়ি-আসানসোল রুটের ভিড়ে ঠাসা বাস। সিট পেয়ে, বাসযাত্রীদের মধ্যে নিশ্চিন্তে বসে এক দম্পতি ও তাঁদের মেয়ে। সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসটি ছাড়ব ছাড়ব করছে। ঠিক তখনই স্ত্রী-র আবদার, মোরব্বা নিলে না! সিউড়ি ছুঁয়ে যাচ্ছি মোরব্বা নেব না তা কি হয়!
মোরব্বা! আবার মোরব্বা কে খাবে?
স্বামী ততটা উৎসাহী নন। কিন্তু স্ত্রী অনড়। মোরব্বা নিতেই হবে। স্ত্রীর আবদার রাখতে অগত্যা মোরব্বা নিতে ছুটলেন ভদ্রলোক। হন্তদন্ত হয়ে স্বামীর মোরব্বা নিয়ে আসা ইস্তক বাসের কন্ডাকটরকে বুঝিয়ে বাস থামিয়ে রাখলেন ভদ্রমহিলা।
না এ কোনও ব্যতিক্রমী দৃশ্য নয়। শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের মিহিদানা-সিতাভোগ কিংবা কৃষ্ণনগরের সরভাজার মতো সিউড়ি শহরের সঙ্গেও দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে জুড়ে গিয়েছে মোরব্বার নাম। জেলার সদর শহরে এলে, অনেকেই তাই আম, বেল, শতমূল, পেঁপে, ন্যাসপাতি, আপেল হরিতকি, আমলকী-সহ নানা বর্ণের সুস্বাদু মোরব্বা হয় বাড়ির জন্য নিয়ে যেতে চান, বা চেখে দেখতে চান।
সিউড়ি শহরে মোরব্বা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী পরিবারের প্রবীন সদস্য নন্দদুলাল দে জানান, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, রাজ্যের মন্ত্রি ,আমলা, যাদুকর, অভিনেতা, খেলোয়াড় থেকে সংস্কৃতি জগতের অনেক স্বনামধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁরা সিউড়ির মোরব্বার স্বাদ চেখে দেখেছেন এবং তৃপ্ত হয়েছেন। সিউড়িতে এসে মোরব্বা নিয়েও গিয়েছেন অনেকেই। সেই তালিকায় রয়েছেন সিনিয়ার ও জুনিয়ার পিসি সরকার, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, লালুপ্রসাদ যাদব, বহু প্রখ্যাত আমলা, অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমারের মতো বিশিষ্ট চলচিত্র অভিনেতার নাম। এমনকী উত্তমকুমারের জন্যও মোরব্বা গিয়েছে সিউড়ি থেকে।
তবে যে মিষ্টিকে ঘিরে শহরের মানুষ গর্ববোধ করেন সেই মোরব্বা কিন্তু সিউড়ি শহরের নিজস্ব নয়। ইতিহাস বলছে, বীরভূমের একদা রাজধানী রাজনগরই জেলায় প্রথম মোরব্বার স্বাদ পেয়েছে। মুসলিম রাজাদের শাসনকালে কোনও এক রাজা উত্তর ভারতে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার চালকুমড়োর মোরব্বা খেয়ে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে সেখান থেকে কারিগর আনিয়ে রাজনগরেই মোরব্বা বানানোর ব্যবস্থা করেন। সেই কারিগদের কেউ কেউ পরে সিউড়ি এসে, কোন মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীর কাছে কাজ যোগ দিয়েছিলেন।
সিউড়ির টিনবাজার এলাকায় নন্দদুলালবাবুর ঠাকুরদা সজনীকান্ত দে, বাবা দিগম্বরপ্রসাদ দে-রা বহু বছর ব্যবসা করছেন। ৭০ এর দশকে সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড তৈরি হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ চার দশক ধরে বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকায় ব্যবসা চালাচ্ছেন তিনি। এখন নিজে খুব একটা ব্যবসা দেখেন না, মূলত ব্যবসার কাজ দেখেন তাঁর ছেলে গৌরাঙ্গপ্রসাদই। বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া যে তিনটি বিখ্যাত মোরব্বার দোকান রয়েছে, এবং যাঁরা মোরব্বার সঙ্গে সিউড়ির নাম গেঁথে ফেলেছেন অভিজ্ঞতায় নন্দদুলালবাবুই সব চেয়ে সমৃদ্ধ। তিনি বলেন, “পারিবারিক ব্যবসায় প্রথম থেকেই বেনারসের কারিগর থাকলেও কয়েক দশক আগেও বেল, পেঁপে বা শতমূলের মত কয়েকটি প্রথাগত মোরব্বা ছাড়া অন্যান্য মোরব্বা তৈরি হত না। পরে অন্যান্য ফলের মোরব্বা তৈরি করে গনেশু প্রসাদ। বেনারসের ওই কারিগর বাপ-ঠাকুরদার সময় থেকে কাজ করতেন।”
শুধু মোরব্বা কেন, আম, লেবু তেঁতুল, আদা, লঙ্কা, ওল, আমড়া, জলপাই চালতা-সহ বিশ রকম আচারও সিউড়িতে এখন সমান জনপ্রিয়।
উনত্রিশ বছর ধরে অন্যান্য মিষ্টির সঙ্গে সমান তালে আচার ও মোরব্বা তৈরির সঙ্গে যুক্ত সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া আর এক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সুপ্রকাশ মণ্ডল বলছেন, “মোরব্বা তৈরি আমাদের কাছে মোরব্বা শিল্প। আমরা সেটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।” কিন্তু যেভাবে প্রতিটি জিনিসের বাণিজ্যকরণ হচ্ছে, খাদ্যপ্রক্রিয়া করণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাতে মোরব্বা শিল্পের ভবিষ্যত কী? কেউ কেউ বলছেন, বেশি দিন ভাল থাকার মতো যথেষ্ট উন্নত ধরনের প্যাকেজিং করে জেলার বাইরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। সুপ্রকাশ মণ্ডল বলেন, “কীভাবে মোরব্বা আও দীর্ঘ সময় ভাল রাখা যায় তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা হয়েছে।”