অতিরিক্ত জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করার পথে।—নিজস্ব চিত্র।
সারদা-কাণ্ডের জের চলছে এখনও। এলাকায় থাকতে তাঁরা ও তাঁদের পরিবারের লোকজন নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন জানিয়ে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের জন্য জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেন একটি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টরা।
শুক্রবার ওই সংস্থার অনেক এজেন্ট পুরুলিয়া শহরে এসে অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সবুজবরণ সরকারের সঙ্গে দেখা করেন। সারদা-কাণ্ডের পর তাঁরা দুবির্ষহ অবস্থার মধ্যে এলাকায় দিন কাটাচ্ছেন জানিয়ে অতিরিক্ত জেলাশাসককে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানান। এজেন্টরা জানান, তাঁদের সংস্থা আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে বলে একটি দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তার পর থেকেই সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের দেখা মিলছে না। আমানকারীদের একাধিক চেক বাউন্স করছে। তাতে জনরোষ আরও বাড়ছে। টাকা ফেরতের জন্য আমানতকারীরা তাঁদের উপরে চাপ সৃষ্টি করছেন। এই অবস্থায় প্রশাসন তাঁদের পাশে দাঁড়াকআবেদন ওই এজেন্টদের। অতিরিক্ত জেলাশাসক বলেন, “ওই এজেন্টরা তাঁদের নানা অসুবিধার কথা বলেছেন। তাঁদের হিসেব অনুযায়ী, জেলায় ওই অর্থলগ্নি সংস্থার দুই হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি রয়েছেন। আমরা বিষয়টি পুলিশকে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।”
ওই অর্থলগ্নি সংস্থাটি ২০০৮ সাল থেকে পুরুলিয়ায় কাজ শুরু করে। এজেন্টরা নিজেদের এলাকায় ওই সংস্থার হয়ে আমানত সংগ্রহ করতেন। ধীরে ধীরে জেলার বিভিন্ন ব্লকে ব্যবসা বাড়াতে থাকে। পুরুলিয়া শহরের নামোপাড়া এলাকায় সংস্থা অফিসও করে। দুর্গাপুর শহরেও সংস্থার বিরাট অফিস রয়েছে। এজেন্ট সুভাষ কাঞ্জিলাল, ত্রিলোচন মাহাতো, শ্যামল মোদকরা জানান, তাঁদের সংস্থার স্থায়ী আমানতে অর্থ ফেরতের পরিমাণ ছিল পাঁচ বছরে দ্বিগুণ, আট বছরে চার গুণ, দশ বছরে ছ’গুণ আর বারো বছরে দশ গুণ। কিন্তু, সারদা-কাণ্ডের পর, গত সেপ্টেম্বর থেকে পুরুলিয়া ও দুর্গাপুর অফিসের ঝাঁপ বন্ধ। সংস্থার দুই অধিকর্তার মোবাইল নম্বর তাঁদের কাছে ছিল। তার একটি বন্ধ। অন্য নম্বরেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
ওই এজেন্টরা জানিয়েছেন, সংস্থাটি পুরুলিয়ায় বছরে প্রায় ৮০-৯০ লক্ষ টাকার ব্যবসা করত। এখন টাকা ফেরত দিতে না পারায় গ্রামে তাঁদের তো বটেই, এমনকী পরিবারের লোকজনের সঙ্গেও অনেক আমানতকারী অপমানজনক ব্যবহার করছেন বলে তাঁদের অভিযোগ। কয়েক জন এজেন্টের বাড়িতে ধানের গোলাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে টাকা ফেরত না পাওয়ার রোষে। রঘুনাথপুরের চেলিয়ামার বাসিন্দা মিহির দে বা পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা সন্দীপ মুখোপাধ্যায়রা এ দিন বলেন, “আমরা প্রচণ্ড উদ্বেগে রয়েছি।” ঝালদার গুড়িডি গ্রামের বাসিন্দা পিন্টু মাহাতোর অভিযোগ, “আমি আমানতকারীদের হাতে মার খেয়েছি। ছেলেমেয়েরা বাইরে বেরোতে পারছে না। ফোনে গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে প্রতিদিন। লুকিয়ে থাকার মতো অবস্থা।” পশুপতি মাহাতো নাম ঝালদার আর এক এজেন্টের কথায়, “আমাকেও ফোনে আমানতকারীদের কাছ থেকে নানা হুমকি পেতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, টাকা যে ভাবেই হোক ফেরত দিতে হবে।”
সংস্থা ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার পরে অনেক এজেন্টই এলাকায় ছোট দোকান, টিউশনি বা টুকটাক কিছু একটা করে কোনও রকমে সংসার চালান। চেলিয়ামার বাসিন্দা বিবেক চক্রবর্তীর কথায়, “এখন সেটাও বন্ধ। বাড়িতে এসে লোকে গালাগালি দিচ্ছে। কেউ বলছে, মামলা করবে।” পুরুলিয়া ২ ব্লকের সিংবাজার গ্রামের বাসিন্দা, সংস্থাটির এজেন্ট সুবীর দাস বললেন, “আমানতকারীরা জমি বেচে টাকা দেওয়ার জন্যও চাপ দিচ্ছে।” পুরুলিয়া শহরের বাপি চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের এক প্রতিনিধি বাঁকুড়ার জোড়দা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি সংস্থার জন্য প্রায় ২৭ লক্ষ টাকার আমানত সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি অসুস্থ।”
এজেন্ট সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ কাঞ্জিলাল, ত্রিলোচন মাহাতোরা বলেন, “আমানতকারীদের অর্থ কী ভাবে ফেরত দেব, এখন সেই চিন্তায় আমাদের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে। নিরুপায় হয়ে আমরা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি। একমাত্র প্রশাসনই পারে সংস্থাকে আমানতকারীর টাকা ফেরতে বাধ্য করতে।”