জলখাবারে কস্তার মিঠাই

প্রায় হারাতে বসা কস্তার মিঠাইয়ের স্বাদ ফিরছে পুরুলিয়ায়। শতবর্ষ প্রাচীন পঞ্চকোট রাজঘরানার এই সুস্বাদু মিষ্টান্নে এবার মজতেই পারেন পুরুলিয়াবাসী। সৌজন্যে মানভূম সমবায় দুগ্ধ উৎপাদক সংঘ লিমিটেড।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৫৫
Share:

চলছে মিঠাই তৈরি। ছবি: সুজিত মণ্ডল।

প্রায় হারাতে বসা কস্তার মিঠাইয়ের স্বাদ ফিরছে পুরুলিয়ায়।

Advertisement

শতবর্ষ প্রাচীন পঞ্চকোট রাজঘরানার এই সুস্বাদু মিষ্টান্নে এবার মজতেই পারেন পুরুলিয়াবাসী। সৌজন্যে মানভূম সমবায় দুগ্ধ উৎপাদক সংঘ লিমিটেড।

প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের অধীন এই সমবায় কিছুদিন আগে মিষ্টি তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। ইতিমধ্যেই তাঁদের তৈরি রসগোল্লা, গোলাপজাম, ভাপা সন্দেশ, ল্যাংচা, কলাকান্দ-সহ বিভিন্ন মিষ্টি বাজারে সাড়া ফেলেছে। এই তালিকায় নবতম সংযোজন পঞ্চকোট রাজঘরানার এই মিঠাই।

Advertisement

একটা সময় ছিল যখন এই মিঠাইয়ের কথা মুখে মুখে ফিরত পঞ্চকোট রাজধানীতে। কারণ, এই মিঠাইয়ের স্বাদ অতুলনীয়, বলছিলেন পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরপুরুষ সোমেশ্বর লাল সিংহ দেও। পঞ্চকোট রাজবংশের শেষ রাজধানী কাশীপুরের এক ময়রা প্রথম মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেওকে এই মিঠাইয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন। কাশীপুরের বাসিন্দা পেশায় মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক দনার্দন দাস মোদকের কথায়, ‘‘আমরা বাবার কাছে শুনেছি রাজা জ্যোতিপ্রসাদ তখন শিকারে যেতেন। ওড়িশার জঙ্গলে শিকারে গিয়ে টানা মাসখানেক সেখানেই ঘাঁটি গাড়তেন তিনি। রাজা মিষ্টির ভক্ত ছিলেন। কিন্তু জঙ্গলে কোথায় মিষ্টি পাওয়া যাবে, রাজা তখন বললেন এমন মিষ্টি বানাও যাতে সেই মিষ্টি থাকে। আমাদেরই পূবপুরুষ কাউকে রাজা একথা বলেছিলেন।’’

গল্পে গল্পে জানা হয়, রাজাকে তখন এই কস্তার মিঠাই তৈরি করে দেওয়া হয় শিকারে যাবার সময় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই মিঠাইয়ের স্বাদে মজেছিলেন তিনি। তারপর থেকে এই মিঠাইয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পঞ্চকোটে। পুরনো দিনের কারিগরেরা জানাচ্ছেন, বিশুদ্ধ গাওয়া ঘিয়ে ছানা, খোয়া, বেসন দিয়ে এই মিঠাই তৈরির জন্য যখন ভাজা হত তখন গোটা এলাকা গন্ধে ম ম করত। পরবর্তীকালে রাজবাড়ির অন্দর মহল থেকেই এই মিঠাইয়ের সুখ্যাতি ছড়ায়। কারিগরেরা জানাচ্ছেন, এই মিঠাই উত্তর প্রদেশের বারানসীর। সেখান থেকে রেসিপি শিখে এসে কাশীপুরের রাজবাড়ির ভিয়েন কস্তার মিঠাই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এই মিঠাই বা লাড্ডুর নাম কস্তা কেন তার কোন বাখ্যা মেলেনি।

পঞ্চকোট রাজঘরানার এই মিঠাইয়ের স্বাদে মজেছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে দিল্লির অনেক নেতাই। এই রাজপরিবারের সন্তান তথা পুরুলিয়ার বিধায়ক কে পি সিংহ দেও বলেন, ‘‘অনেকদিন আগের কথা। একবার আমি কলকাতায় প্রণববাবুর বাসভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় তিনি আমাকে ওই মিঠাইয়ের কথা বলতে আমি লজ্জা পেয়ে যাই। পরে জেনেছিলাম আমার কাকা শঙ্করনারায়ণ সিংহ দেও যিনি বিধায়ক ও সাংসদও ছিলেন তিনিই প্রণববাবুকে এই মিঠাইয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন।

মানভূম সমবায় দুগ্ধ উতপাদক সংঘ লিমিটেডের পরিচালন অধিকর্তা পীযূষ রায় বলেন, ‘‘পঞ্চকোট রাজঘরানার এই মিঠাইয়ের স্বাদ জেলা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। আমাদের এক সদস্য বৃন্দাবন মণ্ডল যিনি কাশীপুরের বাসিন্দা তিনি একদিন কথায় কথায় আমাদের কাছে কস্তার মিঠাই তৈরির প্রস্তাব দিতেই আমরা এই মিঠাইয়ের বিষয় সম্পর্কে জেনে উৎসাহী হই।’’ বৃন্দাবনবাবুর কথায়, কাশীপুরের মাত্র কয়েকজনই এই মিঠাই তৈরি করতে জানেন। তাঁদের পরে এই মিঠাই আর কেউ বানাতে পারবেন বলে জানা নেই। কেন না এতদিনে কোথাও তো দেখিনি। পীযূষবাবুর কথায়, ‘‘কাশীপুরের হাতে গোনা দু-একটি দোকানে এই মিঠাই তৈরি হয়। কিন্তু গোটা জেলা বা এলাকায় তা সেখানেই সীমাবদ্ধ। আমরা এই মিষ্টান্নের কথা জেনে প্রায় হারাতে বসা এই মিঠাইয়ে মিষ্টান্ন প্রেমীদের রসনা তৃপ্ত করার কথা ভেবেই কাজ শুরু করি। কারিগরও কাশীপুর থেকেই আনা হয়েছে।’’

দুগ্ধ সমবায়ের চেয়ারম্যান তথা পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই মিঠাই পঞ্চকোট রাজঘরানার একটি সুস্বাদু মিষ্টি। এর স্বাদ প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল। আমরা সেই স্বাদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। কেননা এটা তো পঞ্চকোট তথা পুরুলিয়ার নিজস্ব ঘরানার মিষ্টি।’’ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর সুগারের সমস্যা রয়েছে। মিষ্টি থেকে খানিকটা দূরেই থাকতে হয়। সেই তিনিও মজেছেন কস্তার প্রেমে। শান্তিরামবাবুর কথায়, ‘‘আমি নিজে মিষ্টি খাই না, তবে কস্তার মিঠাই খেয়ে দেখেছি। দারুণ স্বাদ।’’ পঞ্চকোট রাজবংশের সদস্য সোমেশ্বরলাল সিংহ দেওয়ের কথায়, ‘‘রাজা এই মিঠাই খাওয়ার প্রতিযোগিতা করতেন প্রজাদের মধ্যে। কে কত বেশি খেতে পারেন।’’

কে কত খেতে পারেন, সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বিজয়ার মিষ্টি মুখের জন্য। সে দিনই কস্তার মিঠাই ভোজন রসিকদের অন্য স্বাদে মজবে মনে করছেন প্রস্তুতকারকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন